যৌন হয়রানি বোঝাপড়ার পুনঃপাঠ

আমরা প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী ধর্ষণের খবর জানতে পারি। কিন্তু যখন পুরুষ ধর্ষণের খবর পড়ি, তখন আসলে আমরা কীভাবে সেটিকে গ্রহণ করি? আমাদের মন কি সেটি বিশ্বাস করতে চায়? আমরা প্রশ্ন তুলি, পুরুষ ধর্ষণ? কীভাবে? আমরা মননে-চিন্তায় দোনোমনা করি। কারণ, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের যে এত দিনের বোঝাপড়া আমাদের, সেটি আসলে পুরুষ ধর্ষণকে জায়গা দিতে কেমন এক অস্বস্তি তৈরি করে।

পুরুষদের কি ধর্ষণ করা যায়? কিংবা পুরুষ কি ধর্ষণের শিকার হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলেও খুব সহজে এটি বিশ্বাসযোগ্য হয় না? একজন পুরুষকে কীভাবে যৌন নিপীড়ন করে? আমাদের এই দোটানার কারণ, বেশ কয়েক বছর ধরে পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে ছেলেশিশুকে যৌন নিগ্রহের কথা সামনে এলেও এটিকে যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণ হিসেবে পাঠ করা হয়নি। বরং এ ক্ষেত্রে ‘বলাৎকার’ শব্দটির ব্যবহারই বেশি।

ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির শিকার পুরুষও হতে পারে এবং সে বিষয়ে আইন ও সামাজিক মতাদর্শের পুনঃপাঠ যে প্রয়োজন, সেই আরজি নিয়ে প্রথমবারের মতো মিডিয়ায় হাজির হয়েছিলেন গাজীপুরের জামাল উদ্দিন। তবে জীবিত অবস্থায় তাঁর ওপর বয়ে যাওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি। তাঁর আত্মহত্যার পর ঘটনাটি জানা যায়।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করে আসছিল স্থানীয় কয়েকজন বখাটে। তাদের চাওয়া অনুযায়ী দুই লাখ টাকা না দেওয়ায় বখাটেরা তাঁকে জঙ্গলে নিয়ে যায়। তাঁর মোবাইল ফোন ও টাকা কেড়ে নেয়। তাঁকে তারা ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং সেসব দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে রাখে। সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখায় এবং আরও টাকা দাবি করে তারা। সেই সময়ে দ্রুত টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় বখাটেরা তাঁকে ছেড়ে দেয়। তিনি বাড়ি ফিরে আত্মীয়স্বজনকে বিষয়টি জানান। এপর তিনি চুপচাপ থাকেন। বাইরে বেরোননি। সারা দিন ঘরের ভেতরেই ছিলেন। পরের দিন তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর আত্মীয়স্বজন মিডিয়াকে বলেছেন, জামালকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় এবং লজ্জা-অপমান সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

পুরুষ যৌন হয়রানির শিকার হন কিংবা পুরুষকে ধর্ষণ—এটা অসম্ভব নয়, বরং অসম্ভব মনে করাই ঠিক নয়। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি আইন ও সামাজিক বোঝাপড়ার ভিত্তি আমাদের দেশে নারীকেন্দ্রিকই আছে। সে কারণে যদি কোনো পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগ করতে যান, তাহলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন সেটিকে সমর্থন দেবে না। কারণ, আইনি সংজ্ঞায় কেবল নারীই ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়।

সমাজের লিঙ্গীয় অসমতা ও পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দাপট নারী নিপীড়ন ও নারী ধর্ষণের চিত্রই সামনে আনে। সমাজে নারীরা এখনো ক্ষমতার নিক্তিতে অনেক নিচে, নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক বেশি। যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক প্রচলিত আইনি ও সামাজিক চর্চা থেকে এমন বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই এগুলোকে ‘নারীর বিষয়’ মনে করা হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে পুরুষের বা ছেলেশিশুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি দশজনের একজন পুরুষ যৌন নির্যাতন এবং নানা ধরনের অশোভন আচরণের শিকার হয়। ভারতীয় পুরুষের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ ও নারী কর্তৃক নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়। মেয়েদের ধর্ষণ নিয়ে যেমন গবেষণা হয়, পুরুষদের ধর্ষণ নিয়ে তার ১ শতাংশও হয় না। কিন্তু বহু সমীক্ষা বলছে, পুরুষেরাও ধর্ষণের শিকার হয়, আর তার সংখ্যা যতটা মনে করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শুধু আইন নয়, যৌন নিপীড়ন ও নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হলেও পুরুষেরা সেটি প্রকাশ করতে চায় না।

কেন পুরুষ নিজের যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করতে চায় না? এ ক্ষেত্রেও কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। মনে করা হয়, পুরুষের যৌন হয়রানির প্রকাশ একটা নারীসুলভ স্বীকারোক্তি। এই নিপীড়নের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলে তাকে সমাজ দুর্বল, ক্ষমতাহীন ও অসহায় ভাববে, এতে আক্রান্ত হবে তার পুরুষতান্ত্রিক মন। কোনো পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হলে উল্টো তাকে হাসির পাত্র হতে হয়; তাকে ‘মেয়েলি’ বলা হয়। এই সমাজ যেমন একজন নারীকে শেখায় তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা চেপে যেতে, তেমনি পুরুষকেও নিরুৎসাহিত করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির পরে মনস্তাত্ত্বিকভাবে যে ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত হয়, একজন পুরুষও সে রকম বোধ করতে পারে। বর্তমান আইনে যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা অন্য কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করে, তবে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।

তবে একটা বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, নারী ধর্ষণ ও নিপীড়ন পুরুষ ধর্ষণ ও হয়রানির চেয়ে অনেকটাই বেশি। তাই প্রবণতা এবং ঝোঁকের মাপকাঠিতে দুটিকে একভাবে হয়তো দেখা যাবে না বা তুলনীয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো দুটির জন্য আইন থাকা এবং যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ সংজ্ঞায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করা। কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য মানুষের শরীরকে যৌনবস্তু হিসেবে বিবেচনা না করা, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ বন্ধ করা, সেটির শিকার নারী কিংবা পুরুষ যে–ই হোক, তার বিপরীতে আমাদের লড়তে হবে সম্মিলিতভাবে।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]