এই শিক্ষা কার কাজে লাগছে?

পৃথিবীতে কত মানুষ কতটা দৈন্যদশার মধ্যে জীবন ধারণ করছে, সেটি এখন পর্যন্ত অনেকেরই ধারণার বাইরে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশ নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে না এবং প্রতি ১০ জনে ১ জন শিশু শ্রমে নিয়োজিত। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে, বিনষ্ট বাড়ছে ঠিকই, সেই সঙ্গে সামাজিক সমস্যাগুলো বেড়ে চলছে হু হু করে। এটা বলা যায় যে আমরা যদি বর্তমানের আঙ্গিকে জীবনযাপন অব্যাহত রাখি, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের তিনটি পৃথিবীর দরকার হবে! আর সেই সঙ্গে দারিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই!

প্রতিনিয়ত আমরা সবাই কমবেশি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। তাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের আরও বেশি সচেতনভাবে কাজ করে যেতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ করতে সক্ষম, সেগুলোর দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে—যাকে বর্তমানে ‘গ্লোবাল ইউনিভার্সেল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলা হয়ে থাকে। এই টেকসই উন্নয়নের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে নিঃসন্দেহে, যা এখন পর্যন্ত সঠিক কর্মপরিকল্পনার মধ্যে নেই। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির ও শিক্ষার মান, বিষয়বস্তু—সবকিছু হতে হবে সমসাময়িক, যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে মাথায় রেখে করা যায়। শুধু নতুন নতুন বিভাগ কিংবা পাঠ্যসূচি খুললেই এই সমস্যার সমাধান হবে না, যদি নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য না থাকে।

খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে বোঝানো যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো ছাত্রছাত্রী কোনো ধরনের সামাজিক টেকসই উন্নয়নের কোনো আইডিয়া বা চিন্তাভাবনা যখন নিয়ে আসবে, তাদের একার পক্ষে সেগুলো বাস্তবায়ন করা খুব বেশি সম্ভব হবে না। অথচ আমরা দেখেছি, ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট চিন্তাভাবনা বা আইডিয়া এই সমাজে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অনেকটাই সম্ভব তাদের সাহায্য করা। টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পর্যালোচনার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে সেগুলো নিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য খুব বেশি কঠিন কিছু না। তবে সে ক্ষেত্রে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করার প্রয়োজন আছে বৈকি।

বর্তমানে দেশে প্রায় সব কটি জেলা শহরেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, যেগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু স্থানীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে পারে এবং সেই লক্ষ্যে তাদের বিভিন্ন বিভাগীয় সিলেবাস, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হতে পারে। তখন দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সামাজিক উন্নয়নের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে এবং এতে করে সাধারণ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিরা উপকৃত হবে অনেক বেশি। এমনটাই ভাবছে বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়। তারা এখন শুধু নির্দিষ্ট কোনো বিভাগ না খুলে সামগ্রিকভাবে ভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে নতুন নতুন এমন কিছু বিভাগ খুলছে, যে বিভাগগুলো সম্মিলিতভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় করে বিভিন্নভাবে তার সমাধানের পথ খুঁজছে। আর এসব বিভাগ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কারণ তাদের মতে, ‘টেকসই উন্নয়ন ডিজাইন স্কুল’ হবে এমন একটি সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্র, যেখানে মানবতার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে এবং তার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা হবে। এভাবে কাজ করতে গিয়ে তারা দেশি-বিদেশি নামকরা অধ্যাপককে আমন্ত্রণ করে, যাতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বড় গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়।

কারণ, একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বছরে বছরে ছাত্রছাত্রীদের পাস করাবে না বরং সমাজের প্রতি সামাজিক উন্নয়নে তাদের কিছু দায়বদ্ধতা অবশ্যই থাকবে। সবশেষে টাইমস হায়ার এডুকেশনের প্রধান তথ্য অফিসার ডানক্যান রোজের মতে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যভিত্তিক ওপেন সোর্স থাকতে পারে, যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নে তাদের ভূমিকা খুব সহজেই সবাই জানতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বৈকি!

এবার একটু চোখ ফেরানো যাক আমাদের দিকে। কী করছি আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়? সেখানে কি সত্যি সঠিক গবেষণা হচ্ছে ন্যূনতম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও? কিংবা সেই গবেষণাগুলো আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা পালন করছে? অন্যভাবে বলা যেতে পারে, আমরা যে গবেষণাগুলো করছি, সেগুলো কি আদৌ সঠিকভাবে আমাদের সমাজে প্রয়োগ করতে পারছি মানবতার কল্যাণে? কিংবা এই মনোভাব নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছি? শিক্ষার থেকে ক্ষমতা, রাজনীতি, দলাদলি—এগুলোই যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রাধান্য পাচ্ছে, সেখানে সঠিক শিক্ষার পরিবেশ আসলেই থাকবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছ থেকে দিনকে দিন দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষকেরা যেখানে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে কথা বলবেন, অধিকার নিয়ে কথা বলবেন, সেখানে তাঁরা কথা বলছেন বিবিধ বিষয় নিয়ে। অথচ নিজেদের ঘরেই কিছু নেই—ফাঁকা, অন্তঃসারশূন্য! সাময়িকভাবে হয়তো–বা কেউ কেউ কিছুটা লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমরা দিনকে দিন মৌলিক শিক্ষাক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য জাতিতে পরিণত হচ্ছি, নিজেদের মর্যাদা নিজেরাই হারাচ্ছি, যার ভবিষ্যৎ রূপরেখা ভয়াবহ! এই বোধটুকু কি আমাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই? বরং এগুলো করে দেশের সাফল্যকে-অর্জনকে আরও বেশি ম্লান করে দিচ্ছি নিজেদের অজান্তেই।

সজল চৌধুরী: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক