আশকারা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা

২৬ আগস্ট প্রথম আলোর ১৫ পাতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৬ মাসে ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড (খেলাপি) ঋণ ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা বেড়ে ২০১৯ সালের ৩০ জুন ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে মর্মে খবর প্রকাশ করার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বাড়ার ব্যাপারটি অর্থমন্ত্রী অস্বীকার করায় খবরের শিরোনামে বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, ‘কোনটা সত্যি, অর্থমন্ত্রীর কথা নাকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য?’

আসলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গত ৩০ জুন যে হিসাব (দেড় লাখ কোটি টাকা) প্রথম আলো প্রকাশ করেছে, তাতেও গলদ রয়েছে। কারণ, উল্লিখিত এই অঙ্কের চেয়ে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ অনেক বেশি। কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরছি। প্রথমত, ব্যাংকমালিক, পরিচালক ও বড় ঋণখেলাপিরা অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে যেসব খেলাপি ঋণ রিশিডিউলিংয়ের নিয়মানুগ সীমা তিনবারের বেশি, এমনকি নয়-দশবার পর্যন্ত পুনঃ তফসিলীকরণ করিয়েছেন, সেগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব খেলাপি ঋণের মামলা অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন সেগুলোকে খেলাপি ঋণ বলা যায় না। তৃতীয়ত, যেসব পুরোনো মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয় সেগুলোর ওপর সুদ ধার্য হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের সদু-আসলে পরিমাণ প্রকাশিত হয় না। চতুর্থত, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে রায় হওয়ার পর যাঁরা উচ্চতর আদালতে আপিল করে আপিল মামলাগুলোকে নিজেদের অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন, তাঁদের খেলাপি ঋণকে আপিল মামলা চলার সময় খেলাপি ঋণ অভিহিত করা যায় না।

দেশের সিংহভাগ খেলাপি ঋণ এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এর মানে, খেলাপি ঋণ সমস্যা প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি সংকটজনক পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ, অর্থমন্ত্রী গত ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তা স্বীকারই করতে নারাজ। তিনি সাংবাদিকদেরও খেলাপি ঋণ বাড়ার খবরটি বিশ্বাস না করতে বলেছেন। তাঁর এহেন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থমন্ত্রী মহোদয় দেশের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী হলেও তিনি যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, তাঁকে এ ব্যাপারে কঠোরতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে এগোতেই হবে, গোষ্ঠীপ্রীতির ওপরে উঠে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই রাঘববোয়ালদের বেশির ভাগই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’।

দুঃখজনক হলো, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই খেলাপি ঋণ–সম্পর্কিত অর্থমন্ত্রীর উক্তিগুলো সমস্যাকে আরও সংকটজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ব্যাংকাররা অভিযোগ করছেন, তাঁর নির্দেশমতো বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দেওয়ার আগেই তাঁর বক্তব্যগুলো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় অনেক নিয়মনিষ্ঠ ঋণগ্রহীতাই ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ করেননি। তাঁদের যুক্তি ছিল, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মোতাবেক ২ শতাংশ খেলাপি ঋণের অর্থ ফেরত দিয়ে যদি ৯ বছরে বাকি ঋণ ৯ শতাংশ সুদে কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়, তাহলে তাঁরা ওই নতুন সুবিধা নেবেন না কেন?

অর্থমন্ত্রীর এখনকার বক্তব্য ‘কেউ টাকা দিচ্ছেন না। অর্থাৎ ভালো গ্রাহকেরাও দিচ্ছেন না।’ এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার মোতাবেক এই ঢালাও সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হন, তাহলে অর্থমন্ত্রী-কথিত ‘ভালো গ্রাহকেরা’ কেন এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন? এরই কুফল হিসেবে গত ছয় মাসে ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।

অর্থমন্ত্রী মহোদয় এখনো দাবি করছেন, তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করতে না পারায় এটা বেড়ে গেছে, তবে শিগগিরই এর সুরাহা হয়ে যাবে। তাঁর এই দাবি সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সুস্পষ্ট অভিমত, ‘অর্থমন্ত্রী যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণ কমাতে চাইছেন, তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না। এভাবে খেলাপি ঋণ কমবে সাময়িকভাবে। দুই থেকে তিন বছর পরই সংকট বড় আকারে দেখা দেবে।’ ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, যাঁদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত, উল্টো তাঁদের ব্যাংক থেকে আরও টাকা বের করে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

এ গুরুতর অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী কি উপলব্ধি করতে পারছেন? ইব্রাহিম খালেদ বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই পরিচিত। তিনি যখন এই গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেন, সেটা এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। একই আশঙ্কা আমিও প্রকাশ করেছি মে মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কলামে। আমি বলেছি, ‘অর্থমন্ত্রীর টোটকা দাওয়াই দিয়ে খেলাপি ঋণের ক্যানসারকে সারানো যাবে না। বরং, “দয়ার সাগরের” ভূমিকায় অবতীর্ণ অর্থমন্ত্রীর অন্যায় প্রশ্রয় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের আরও আশকারা দিচ্ছে কি না ভেবে দেখা উচিত।’
মার্কিন গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন মোতাবেক ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আড়াই শ কোটি টাকার বেশি ধনসম্পদের মালিক ২৫৫ জন ব্যক্তি চিহ্নিত হয়েছেন, যাঁদের সিংহভাগ ঊনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রবার ব্যারনদের’(যারা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনৈতিক পথ ধরে সম্পদ অর্জন করেছিলেন) চারিত্র্য ধারণ করছেন। দেশের ‘রবার ব্যারনদের’ প্রকৃত সংখ্যা উল্লিখিত অঙ্কের হয়তো কয়েক গুণ বেশি হবে। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে প্রদত্ত তালিকা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এসব ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছেই দেশের খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশের বেশি আটকে রয়েছে।

বাংলাদেশের এই রবার ব্যারন ব্যাংকঋণ লুটেরারা অর্থমন্ত্রীর দয়াদাক্ষিণ্যের জন্য কোনো যুক্তিতেই উপযুক্ত পাত্র হতে পারেন না। তাঁরা জাতির শত্রু। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলাকে ঔপনিবেশিকে পরিণত করার পর কোম্পানির কর্মকর্তা, সেনাপতি ও সিপাহিরা ১০১ বছর ধরে এ দেশ থেকে যে বিপুল পুঁজি জাহাজের পর জাহাজে ভরে ব্রিটেনে পাচার করেছিলেন। সেটাকেই এখন ঐতিহাসিকেরা ‘দ্য বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করেছেন। বলা হচ্ছে, ওই জাহাজগুলো লন্ডন বন্দরে লুটের মাল খালাস করতে তিন মাসের একটি জাহাজ-জট সৃষ্টি করেছিল।

১৭৫৭-১৮৫৮ পর্বের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এবং ১৮৫৮-১৯৪৭ পর্বের সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭-৭১ পর্বের পাকিস্তানি পুঁজি-লুটেরারা আরও ২৪ বছর পুঁজি পাচারের মাধ্যমে দেশটাকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলার কারণে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ উপাধিতে ভূষিত হতে হয়েছিল। গত ৪৮ বছরে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের কয়েক শ রবার ব্যারন বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ কোটি টাকার বেশি পুঁজি লুণ্ঠনের ও পুঁজি পাচারের প্রধানতম হোতা, তাঁদের কাছেই আটকে রয়েছে ব্যাংকের সিংহভাগ খেলাপি ঋণ। তাঁরা খেলাপি ঋণের বড় অংশটাই বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। অতএব, এই অর্থ কস্মিনকালেও হয়তো ব্যাংকে ফেরত আসবে না। তাঁদের যদি অর্থমন্ত্রীর নির্দেশিত নীতি মোতাবেক আরও ব্যাংকঋণ প্রদানের পথ খুলে দেওয়া হয়, তাতে আরও হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার মওকা অব্যাহত থাকবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি সঞ্চারের কোনো সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে না।

২৭ আগস্ট পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সভায় খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে ১৬টি প্রস্তাব উপস্থাপনের খবর প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের প্রস্তাব নেই দেখে আমি যারপরনাই হতাশ হয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, এক্ষণে ফরজ হলো তিন বছরের জন্য একটি খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ জন ঋণখেলাপিকে চূড়ান্ত বিচারে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা হয় রদ করতে হবে, নয়তো আপিলের ক্ষেত্রে রায়ে উল্লিখিত ঋণের অর্থের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ব্যাংককে ফেরত দিলে আপিলের সুযোগ দেওয়া যাবে মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সম্পত্তি ক্রোকসহ জেলে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রাঘববোয়ালেরা খেলাপি ঋণ ফেরত দেবেন কি না জানি না, তবে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালাবেন।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক