ধানে গেল বানে গেল, পাটেও যায় যায়

এখনো ধানের দাম মণপ্রতি ৪৫০ টাকা। আর্দ্রতার দোহাইয়ে ধান নেয়নি খাদ্যগুদাম কর্তৃপক্ষ। মধ্যম আয়ের দেশ, অথচ সরকারের সব ধরনের ধান কেনার সামর্থ্য নেই! কোথাও কোথাও ধানের খেতে আগুন দিয়েছেন কৃষক। ক্ষোভে ও ক্ষুধার জ্বালায়। ষাঁড়ের চামড়ার দাম ২০০ টাকা হলে একটি চামড়ার বেল্টের দাম ১৫০০ টাকা যেভাবে হয়, তেমনি চাতাল থেকে চাল কেজিপ্রতি ৩২ টাকা হয়ে বেরোয়। দাম নির্ধারণের ক্ষমতা গরুর মালিক ও জমির মালিকের নেই। এই রাজনৈতিক প্রশ্নটি এড়িয়ে আর কতকাল?

ধানের দামের ক্ষত না শুকাতেই এল বান। যত বড় বান, তত বড় ক্ষতি। এবার উচ্চতায় ছাড়িয়ে গেছে ১৯৮৮ সালকেও। কুড়িগ্রাম জেলায় বানের দগদগে ঘা সর্বত্র। ব্রহ্মপুত্রের মধ্যখানে চিলমারীর খোর্দ বাঁশপাতা, খোর্দ খামার, মনতলা, সিরাজবেগসহ কয়েকটি চরের গ্রামের ভেতর দিয়ে বাড়িঘর উধাও করে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বয়ে গেছে। কোনোমতে গরু-মহিষ রক্ষা পেয়েছে। ভয়াবহ অবস্থা কাইম এলাকায়। সেখানে রেলসড়ক ও বাঁধ ভেঙেছে। রমনার ভট্টপাড়ায় বাঁধ ভেঙে গভীর ‘হ্রদ’ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে গোলাপ উদ্দীন (৬০), শহিদুলদের (৪৬) মতো যেসব ভূমিহীন বাস করতেন, তাঁদের বাড়ি বিলীন হয়েছে। তার পাশে জোড়গাছ পুরাতন বাজারের দক্ষিণে বিখ্যাত বাসন্তীর বাড়িবর্তিপাড়ায় পানির ঘূর্ণিতে আনারুলের মা (৬০), মোশরেকুল মিয়া (৫০) ও রাকু মিয়ার (৫৫) বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তাঁরা বাস করছেন খোলা আকাশের নিচে।
কাঁচকোল বুরুজের পাড়। বুড়িতিস্তা ও আরেকটি নদী পশ্চিম ও উত্তর থেকে এসে এখানে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। ১৯৮৮ সালেও এখানে ভেঙেছিল, এবার ভাঙল। আবু বক্কর (৯০) আর ছালামদের (৫০) ঘর যখন শোঁ শোঁ শব্দে পানিতে ভাঙছিল, তখনো কেউ বুঝতে পারেননি নদী থেকে একটু দূরে থাকা নতুন গ্রামের এরশাদুলের (৪৫) নতুন পাকা বাড়িও বালির বাঁধের মতো খসে পড়বে। স্বপ্নের বাড়িটি হারিয়ে এরশাদুল এখন পাগলপ্রায়।

২.
জোড়গাছ হাট, যাত্রাপুরহাট—ব্রহ্মপুত্রপারের বিখ্যাত সব হাট। দশ দিক থেকে হাজারো নৌকা আর ট্রাক এসে ভিড়ছে। হাটের মধ্যে, যেদিকে চোখ যায় বিশাল বিশাল পাটের ঢিবি। গত বছর আবাদ কম ছিল বলে দাম বেশি ছিল। দাম বেশি ছিল বলে এবার কৃষকও আবাদ করেছেন বেশি। এত পাট আবাদ হয়েছে যে শ্রমিকেরা পাট কেটে শেষ করতে পারছেন না। এখনো জমিতে জমিতে পাটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। সেই সুযোগে শ্রমিকেরাও বেশি মজুরি হাঁকছেন। আর সুযোগসন্ধানী আড়তদারেরা তো আছেনই। কৃষক তাই হাটে এসে শোনেন, পাটের দাম নেই। একেক হাটে যান আর পাটের দাম কমে। সামনে বন্যা আসতে পারে—এ এক দুশ্চিন্তা। অন্যদিকে আমন লাগাতে হবে, তার জন্য পুঁজি চাই।

শাখাহাতিচরের মিলন মিয়া (৪০) ও তাঁর বাবা মিলে ভোর থেকে কাজ করেও শেষ করতে পারেন না। এক দিকে পাটের চিন্তা, আরেক দিকে আমনের বীজতলা বানানোর চাপ। তিনি এক বিঘা (৬৩ শতক) জমিতে পাট উৎপাদনের হিসাব দিলেন। বীজ, জমি তৈরি, নিড়ানি, হাল, সার, কামলার খোরাকি, কাটা, জাগ দেওয়া, ধোয়া, শুকানো, পরিবহন, খাজনাসহ মোট খরচ হয় ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা। ৩ হাজার পাটখড়ি বাদ দিলে থাকে ৩৩ হাজার ৫০০। এক বিঘা জমিতে গড়ে পাট মেলে ২০ মণ। মানে মণপ্রতি খরচ প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু হাটে দাম চলছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

অধিকাংশ পাটের জাগ বন্যার কারণে পলিতে তলিয়ে ছিল। ফলে আঁশ কিছুটা কম উজ্জ্বল। ফলে এসব পাটের দাম ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে ওঠে না। অষ্টমীর চরের মঞ্জুর মিয়ার বাপ ওমর আলী (৭০) এক বিঘা জমিতে পাট আবাদ করেছিলেন। অর্ধেক পাটখড়ি দেওয়ার শর্তে অন্যের পুকুরে পাট জাগ দিয়েছিলেন। তাঁর তো আরও ক্ষতি। তিনি বলেন, ‘আগে চিলমারীতে আদমজী, লতিফ বাওয়ানীর গোডাউনের লোকেরা পাট কিনত, পাইকারেরা হামাক তোয়াজ করছিল, এলা উল্টা হামরায় করি।’

৩.
১১৩ দশমিক ৩ একর আয়তনের খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল। শতভাগ আবাসিক শ্রমিক ছিলেন ১২ হাজার, এখন ৩ হাজার স্থায়ী শ্রমিক মাত্র। আগে দৈনিক ১২০-১৩০ টন পণ্য উৎপাদিত হতো। আজও সক্ষমতা আছে ৯০ টনের মতো। কিন্তু কাঁচামালের অভাবে হয় ৩০ টনের মতো। সরকারি পাটকলের সংখ্যা ছিল ৭৭, আছে ২৫টি। অথচ এখন বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ১৭০। দেশের একটি বড় শিল্পগ্রুপ তামাকের ব্যবসা জাপানিদের কাছে বিক্রি করে পাটশিল্পে ঝুঁকছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘ আগামী ২৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীকে প্লাস্টিকশূন্য করার ঘোষণা দিয়েছে। পাটের মতো প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা আবার ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু কৃষকেরা তার ফল পাচ্ছেন কই? একদিন পাটের উদ্বৃত্ত দিয়েই বাঙালি মুসলমানের সন্তান শহরে পড়তে গেছেন। কৃষকের সন্তানেরা গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করে আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কায়েম করেছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিই ছিল পাট। ৫০ বছর পর কি তাঁরা নাই হয়ে গেলেন? ধানে লোকসান গুনছেন কৃষক, বান এসে ভাসাল। এবার পাটে তথৈবচ। কৃষি কৃষকের হাতে না থাকলে কৃষক তো শ্রমিক হয়ে যাবেন, নাই হয়ে যাবেন। সোনালি আঁশের দেশ তার কৃষকের ভুলে গেল কী করে?

নাহিদ হাসান রেল-নৌযোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি