চীন কেন মধ্যপ্রাচ্যের কাছে আকর্ষণীয়

মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা চীনের সমর্থন পাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। যখন এই অঞ্চল মার্কিন নীতির সমালোচনায় মুখর, তখন এর রাজনৈতিক অভিজাতেরা চীনের প্রশংসায় এবং বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বেইজিংয়ের দিকে যাত্রায় ব্যস্ত। উদাহরণস্বরূপ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ২০১৪ সাল থেকে মোট ছয়বার চীন সফর করেছেন। যদিও চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ অংশীদারত্ব এখনো জ্বালানি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কিন্তু প্রতিরক্ষার মতো নতুন ক্ষেত্রগুলোতেও তাদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্প্রতি তাদের জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমে চীনা ভাষায় পড়ালেখা চালুর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া উভয় দেশই (এবং এই অঞ্চলের অন্যরা) মুসলিম উইঘুর জনগোষ্ঠীর ওপর চীনের অত্যাচারের বিষয়টিকে সমর্থন করেছে, পশ্চিমা দেশগুলো যার ব্যাপক নিন্দা করেছে। 

এসব ঘটনা দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কেন মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো চীনের ওপর বাজি ধরেছে? এবং যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, চীন তা কতটা পূরণ করতে পারবে? 

প্রথম নজরে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর চীনের প্রতি নতুন ভালোবাসা বিস্ময়কর। রক্ষণশীল আরব সরকারগুলো কমিউনিস্ট চীন সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে সন্দিগ্ধ ছিল এবং কেবল ১৯৮০ বা ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে তারা চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তা ছাড়া এই অঞ্চলের অনেক দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘকালীন প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের কয়েকজন বিশেষত মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব এখন চীনের সঙ্গে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি করেছে। 

এ ঘটনাগুলো ওয়াশিংটনের ক্রমেই উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। এমনকি মার্কিন সরকার সংবেদনশীল প্রযুক্তি বিষয়ে চীনকে সহযোগিতা করার বিষয়ে ইসরায়েলের কাছে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলের বাজারে চীনা প্রযুক্তি সংস্থা হুয়াওয়ে এবং জেডটিইয়ের প্রবেশ বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েকটি কারণ বর্তমানে চীনকে মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর কাছে একটি আকর্ষণীয় অংশীদার করে তুলেছে। চীনের একটি গতিশীল, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি রয়েছে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তারা অর্থনৈতিক যোগাযোগ এবং আঞ্চলিক বিনিয়োগসমূহ রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। চীন মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ধারণা নয়, শুধু পণ্য রপ্তানি করতে চায়। 

চীনের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সরকার প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কারের পরিবর্তে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের বৈধতা জোরদার করার চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলজুড়ে ২০১১ সালের আরব বসন্তের কথা স্মরণে রেখে বেশ কয়েকটি সরকার জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে উচ্চাভিলাষী জাতীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় বিকল্প। কারণ, তাদের পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কঠিন সম্পর্ক চালাতে হচ্ছে। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কলামিস্ট জামাল খাসোগি হত্যার কয়েক মাস পর এ বছরের শুরুর দিকে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান চীন সফর করেন। পশ্চিমারা দূরে ঠেলে দেওয়ায় মোহাম্মদ বিন সালমান এ সফরের মাধ্যমে তাঁর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিটি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। 

তবে ইরানের বিষয়টি আলাদা। পশ্চিম থেকে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার কারণে ইরান চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া ও ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠা ইরানের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। এর বিনিময়ে চীন পুরোপুরি সুবিধা নিয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইরানকে তার শর্তাবলি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। একই সঙ্গে চীনকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো সমাধান করার ক্ষেত্রে অর্থবহ ভূমিকা নিতে তার সীমিত ক্ষমতার বিষয়ে সচেতন বলে মনে হয়। যেমন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব বা সিরিয়ার সংকট। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রাথমিক অতিরিক্ত আঞ্চলিক খেলোয়াড়।

নীতিগতভাবে এই অঞ্চলে চীনা এবং মার্কিন স্বার্থের মধ্যে কোনো বড় বিরোধ থাকা উচিত নয়। জিবুতি এবং পাকিস্তানের গওয়াদারে নৌঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও চীন মধ্যপ্রাচ্যে কোনো বড় রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে আগ্রহ দেখায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের সঙ্গে চীনের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এত দিন চীন এই অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত থেকে অর্থনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশ করে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। এই ভাবমূর্তি আরব বিশ্বের কাছে চীনকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চীন কি শেষ পর্যন্ত এই ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারবে? অনেকের ধারণা, এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে চীন একসময় মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। দেখা যাক, তাদের ধারণা সত্যি হয় কি না। 

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

গালিপ দালায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক