সাম্রাজ্যও নেই সূর্যও নেই ব্রিটেনের

নিয়মনীতির পথ ছেড়ে ব্রিটিশ সরকার কি শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক পথে হাঁটবে? আপাতদৃষ্টিতে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কাজকর্মে তা-ই প্রতীয়মান হচ্ছে। ব্রেক্সিট গণভোটের পর দীর্ঘ আড়াই বছরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টেমস নদী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, তবে ব্রেক্সিট সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি, বরং বিষয়টি নিয়ে নানা নাটকীয়তার জন্ম হচ্ছে।

কট্টর ব্রেক্সিটবাদী যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদের পথ প্রশস্ত করতে পার্লামেন্টের অধিবেশন মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত করেছেন, আর আন্তর্জাতিক বা জোটের নিয়ম ভেঙে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চুক্তিহীন অবস্থায় বেরিয়ে যেতে চাচ্ছেন। ইইউ জোটের পাওনা পরিশোধেও তাঁর আপত্তি আছে। একদিকে চুক্তিভঙ্গ, অন্যদিকে বকেয়া পাওনার হিসাব মিলাতে না পারলে নিজ মহাদেশেই হয়তো ব্রিটিশরা একঘরে হয়ে পড়বে।

নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রায় চার সপ্তাহ আগে ক্ষমতায় আসীন হলেও তাঁর পূর্বসূরি থেরেসা মের করা ইইউ জোট ছেড়ে যাওয়া-বিষয়ক ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে তিনি নতুন কোনো প্রস্তাবনার কথা বলছেন না। ইইউ জোটের অন্য সদস্যরা উৎসুক রইলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নতুন প্রস্তাব ছাড়া ইইউ জোটের বকেয়া দেনা পরিশোধ করবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি সম্প্রতি ফ্রান্সের বিয়াররিটজে জি-৭ সম্মেলন চলাকালে স্কাই নিউজকে জানিয়েছেন, চুক্তিবিহীন অবস্থায় ব্রেক্সিট সম্পন্ন হলে যুক্তরাজ্য ইইউ জোটের পাওনা ৪২ বিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করবে না। তবে এই দেয় অর্থের বড় একটি অংশ ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যের কৃষকদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবেন বলে জানিয়েছেন।

ইইউ কমিশন এই পাওনা অর্থ দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে শীতল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ইইউ জোটের বাজেট-বিষয়ক কমিশনার গুনথার ওয়েটিংগেন বলেছেন, ‘জোটভুক্ত অন্য ২৭ দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে যুক্তরাজ্যের অবশ্যই চুক্তি মোতাবেক দেনা-পাওনা পরিশোধ এবং তাদের দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে সম্মান করতে হবে। আর তা না হলে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভবিষ্যতে আমাদের সুসম্পর্ক রইবে না।’

ব্রাসেলসে ইইউ জোটের সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জার্মানির ‘ডের স্পিগেল’ পত্রিকা জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউ জোটের দেনা-পাওনার বিষয়টির যতক্ষণ না কোনো সুরাহা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউ জোটের কোনো রকম বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হবে না। সে ক্ষেত্রে চুক্তিবিহীন বিচ্ছেদ ঘটলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেনা-পাওনা বিষয়ে একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে। বিষয়টি বাদ দিয়ে কোনো কিছুই সম্ভব হবে না। পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য ইইউ জোট ছেড়ে গেলেও জোটের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জোটের সঙ্গে দ্রুত তাদের নতুন চুক্তি করতে হবে এবং যুক্তরাজ্যকে তাদের নিজস্ব অর্থনীতিতে শুল্ক এবং বাণিজ্যিক বাধাগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে।

২০১৭ সালের শেষের দিকে ইইউ ও যুক্তরাজ্য সরকার উভয় পক্ষের দেনা-পাওনা বিষয়টি সুরাহা করে একমত হয়েছিল। ব্রিটিশ অফিস আর বাজেট রেসপনসিবিলিটি দেনা-পাওনা বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছিল, এই দেনার পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় ৪২ বিলিয়ন ইউরো।

ইইউ জোটের বিশাল অঙ্কের দেনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার দেশের কৃষকদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবেন, ভালো কথা, তবে এই দেনার কারণটা কী? যুক্তরাজ্যের কাছে ইইউ জোটের পাওনার বিষয় মূলত তিনটি। প্রথমত, ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জন্য ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত সাত বছরের বাজেটের জন্য গৃহীত অর্থের অংশবিশেষ, দ্বিতীয়ত, বাজেটের জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদান, তৃতীয়ত ইইউ জোটে কর্মরত ২০০০ ব্রিটিশ নাগরিকের পাওনা অবসর ভাতার অর্থ প্রদান।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রায় চার সপ্তাহ আগে ক্ষমতায় এসে ব্রেক্সিট বিষয়ে লোকদেখানো কিছু কাজ করছেন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ডোনাল্ড টুস্ককে চার পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছেন। সেখানে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ইইউভুক্ত দেশ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার কৌশল বা ‘ব্যাক স্টপ’ ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর দ্বিমতের কথা জানিয়েছেন।

এরপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বার্লিন ও প্যারিস সফর করে আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও এমানুয়েল মাঁখোর সঙ্গে ‘ব্যাক স্টপ’ ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা বললেও কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব তিনি দেননি। সর্বশেষ তিনি ফ্রান্সের বিয়াররিটজে জি-৭ সম্মেলন চলাকালে স্কাই নিউজকে জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য ইইউ জোটের কাছে বকেয়া ৪২ বিলিয়ন ইউরো পুরোপুরি শোধ করবে না।

বেফাঁস মন্তব্য বা লাগামহীন রসিকতার জন্য পরিচিত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আদতে কী চাচ্ছেন, তা বোঝা দায়। ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চুক্তি বা চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। চুক্তিহীন বিচ্ছেদের বিষয়ে সেখানে পাঁচটি বিরোধী দল একজোট হয়েছে কিন্তু ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ধারা ভেঙে বরিস জনসন পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। অন্যদিকে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিটপন্থী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার আহ্বান জানাচ্ছেন৷ ব্রাসেলসভিত্তিক সূত্রগুলো বলছে, বরিস জনসন নানা বিতর্কমূলক কথাবার্তা বলে সময়ক্ষেপণ করছেন। আদতে তিনি চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের দিকেই হাঁটছেন। তবে চেষ্টা করছেন ইইউ জোটের ওপর এই চুক্তিহীন বিচ্ছেদের দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে।

কিছুদিন আগে লন্ডনের ‘দ্য সানডে টাইম’ ব্রিটিশ সরকারের নথি প্রকাশ করে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট হলে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো ধাক্কার মুখে পড়বে বলে আভাস দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধপত্রের ঘাটতি দেখা দেবে এবং যুক্তরাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটবার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার কারণে যুক্তরাজ্যের কী সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি হচ্ছিল, এবং পুঁজি আর লাভের হিস্যা নিয়ে হঠাৎ আবেগতাড়িত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে খোদ যুক্তরাজ্যেই প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে।

একদা বিশ্বব্যাপী যাদের সাম্রাজ্যে সূর্য ডুবত না, সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখন নিজ মহাদেশেই ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে একঘরে হতে চলেছে। এখন দেখার বিষয়, ব্রেক্সিট নিয়ে বরিস-অধ্যায় কোথায় গিয়ে শেষ হয়।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
Sharaf. [email protected]