রংপুর উপনির্বাচন ও 'অনিচ্ছুক' বিরোধী দল

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, না জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, কার হাতে এখন জাতীয় পার্টি?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, না জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, কার হাতে এখন জাতীয় পার্টি?

রাজনীতিতে সাধারণত পথ ও মত নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু জাতীয় পার্টিতে পথ ও মত নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। জাতীয় পার্টির দুই অংশই সরকারের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে আগ্রহী। কিন্তু দলের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, সেটা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে উতোর–চাপান। নেতৃত্বের শেষ দিকে এসে এরশাদ দলের ওপর কর্তৃত্ব রাখতে পারছিলেন না, বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন। একবার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে সামনে আনতেন, আরেকবার স্ত্রী রওশন এরশাদকে।

কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর কার হাতে এখন জাতীয় পার্টি? দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের, না জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের? দলের একাংশের সমর্থন কাদেরের প্রতি। আরেক অংশ রওশন এরশাদের পক্ষ নিয়েছে।

নতুন চেয়ারম্যান জি এম কাদের সবাইকে নিয়ে চলতে চান। কিন্তু রওশন গ্রুপ প্রথমেই তাঁর নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে রওশন বলেন, সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছেন, জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে আদৌ কোনো যথাযথ ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়নি।

তাঁর সমর্থনে তখন এগিয়ে এসেছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাংসদ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইমাম, সেলিম ওসমান, নাসরিন জাহান রত্না, মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ। এরপর নতুন চেয়ারম্যান জি এম কাদের রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি সামাল দেন। বিরোধী পক্ষও তাঁকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নেয়।

উল্লেখ্য, জীবিত থাকতেই এরশাদ দলে তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ছোট ভাই জি এম কাদেরকে। তাঁকে এর আগে সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা করা হয়েছিল। নতুন উপনেতা হলেন রওশন এরশাদ, যিনি বিগত সংসদের পুরো সময়টাই বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতিতে বরাবর ‘ভারসাম্যহীন’ এরশাদ দলীয় নেতৃত্বে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছিলেন।

জাতীয় পার্টির ভেতরে এখন প্রধান দুটি গ্রুপ। একটি রংপুর কেন্দ্রিক, আরেকটি রংপুরের বাইরের। যদিও দলের চেয়ারম্যান গ্রুপিংয়ের কথা স্বীকার করেন না। তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে জাতীয় পার্টিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে প্রতিযোগিতা আছে।

দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দলের কাদের গ্রুপ আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্যদিকে রওশন গ্রুপ দুর্বল হয়ে পড়েছে। দলের সংসদীয় ও প্রেসিডিয়ামের যৌথ সভায় প্রস্তাব করা হয়, দলের প্রধানই যেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সব দলই এই নীতি অনুসরণ করে, জাতীয় পার্টিতে ব্যতিক্রম হবে কেন। এই সভায় কোনো কোনো সাংসদ জি এম কাদেরের পক্ষে স্পিকারের কাছে চিঠি লেখারও প্রস্তাব করেন। ওই সভায় রওশন এরশাদসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা অনুপস্থিত ছিলেন। দলীয় সূত্র বলছে, দলের বেশির ভাগ সাংসদ জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দেখতে চাইলেও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তাজুল ইসলাম, মুজিবুল হক প্রমুখ রওশন এরশাদের পক্ষে।

এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর সদর আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থিতা নিয়েও দলে একধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। রওশন এরশাদ ও তাঁর অনুসারীরা চান এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদ প্রার্থী হোন। অন্যদিকে এরশাদের ভাগনি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুর স্ত্রী জেবুন্নেসা, জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াসিরও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। প্রার্থী হিসেবে এরশাদের আরেক পুত্র এরিক এরশাদের নামও এসেছে; যদিও তাঁর মা বিদিশা চান না তিনি প্রার্থী হোন। এরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যুবক। তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা সম্ভব নয়। সাদ এরশাদ নিজেও প্রার্থী হতে আগ্রহী এবং কয়েকবার রংপুর সফর করেও এসেছেন। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, তৃণমূল থেকে নাম আসবে, এরপর মনোনয়ন বোর্ডে যাঁর জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।

নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগেই রংপুরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জাতীয় পার্টির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহলেও জোর তৎপরতা চলছে। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু ও কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান। বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মহানগর কমিটির সভাপতি মোজাফফল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম।

এ কথা সত্য যে রংপুরই জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া এরশাদের প্রতি রংপুরবাসীর যে আবেগ ছিল, নির্বাচনে সেটাও জাতীয় পার্টি কাজে লাগাতে চাইবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শুধু স্থানীয় মানুষের আবেগ ও সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে জয় নিশ্চিত করা যাবে না। সরকারি দল যদি না চায়, তাহলে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির জয়ী হওয়া কঠিন হবে। কেননা, রংপুরে এরশাদের পক্ষে যে আবেগ আছে, বগুড়ায় জিয়াউর রহমানের পক্ষে আবেগ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারপরও গত নির্বাচনে বিএনপিকে সেখানে মাত্র দুটি আসন পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। আসনটি ধরে রাখা জাতীয় পার্টি ও দলের নতুন চেয়ারম্যান উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় বাইরে জাতীয় পার্টি পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে এগোতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে দলের ভবিষ্যৎ নীতি ও কর্মপন্থার ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন নজির নেই যে সরকারের আনুকূল্য নিয়ে কোনো বিরোধী দল জনগণের সমর্থন বাড়াতে পেরেছে। স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টিই তার প্রমাণ। আ স ম আবদুর রব একসময় এরশাদের আনুকূল্যে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন। কিন্তু দল টিকিয়ে রাখতে পারেননি।

জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা গত দুই মেয়াদে মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়ে এখন আর বিরোধী দলের আসনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। এবারেও জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদার হতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা ‘নির্ভেজাল’ আওয়ামী লীগ ছাড়া সরকারের ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায়নি। এ কারণে জাতীয় পার্টির পাশাপাশি ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদও ক্ষমতার বাইরে থেকে গেছে। এদের বলা যায় অনিচ্ছুক বিরোধী দল। এই অনিচ্ছুক বিরোধী দল ইচ্ছুক বা সত্যিকার বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব জানার অপেক্ষায় আছি।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো চলে একক কর্তৃত্বে। যিনি যেই দলের প্রধান থাকেন, তাঁর কথার বাইরে কিছু হয় না। জাতীয় পার্টি ও বিএনপির জন্য এটি আরও বেশি সত্য। কেননা, এই দুটি দলের গঠনতন্ত্র এমনভাবে করা, যেখানে দলীয় প্রধান যেকোনো সময়ে যেকোনো ব্যক্তিকে দলের যেকোনো পদে বসাতে পারেন কিংবা বাদ দিতে পারেন।

তবে জি এম কাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর এখনো সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি সত্যি সত্যি দলে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কি?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]