জাতীয় সংসদ কখন অকার্যকর হয়

গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশ ১১টি জাতীয় সংসদ পেয়েছে। এর মধ্যে সামরিক-আধা সামরিক সরকারের আমলে যেসব সংসদ গঠিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনামলে গঠিত সংসদগুলোর কার্যকারিতা আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দেশে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয় নব্বইয়ে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিদায়ের পর, ১৯৯১ সালে। 

কিন্তু পরবর্তী কোনো সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল পুরো মেয়াদে একসঙ্গে কাজ করেছে, এ রকম উদাহরণ নেই। বিশেষ করে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো এবং বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলো সংসদ বর্জনকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ একমাত্র উপায় হিসেবে নিয়েছিল। আর সেই সুযোগে সরকার নিজের ইচ্ছেমতো সংসদ পরিচালনা করেছে, আইন তৈরি করেছে। নবম সংসদ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। 

দশম সংসদে এসে দেশের মানুষ নতুন অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। ওই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রতিবাদে। ফলে পোয়াবারো হয় এরশাদের জাতীয় পার্টির। দলটি নির্বাচন নিয়ে অভিনব নাটক মঞ্চস্থ করে এবং দশম সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। একই সঙ্গে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ওই সংসদে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল ছিল না। মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করেছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল শুধু সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয় না, নিজেরাও বিকল্প বা ছায়া সরকারের দায়িত্ব পালন করে। ব্রিটেনে বিরোধী দল সরকারের প্রতিটি দপ্তরের জন্য একজন ছায়া মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের কোনো নীতি পছন্দ না হলে তাঁরা শুধু সমালোচনা করে দায়িত্ব শেষ করেন না, বিকল্প প্রস্তাবও উত্থাপন করেন। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কিছু সময়ের জন্য ধারাটা শুরুও করেছিল। এরপর ‘তত্ত্বাবধায়কের প্রলয়’ সবকিছু তছনছ করে দেয়। দুই পক্ষের মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। 

এই প্রেক্ষাপটে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির গবেষণায় দশম জাতীয় সংসদের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অস্বাভাবিক নয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার ও সংসদ একাকার হয়ে যেতে পারে না। সংসদের কাছে সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ জবাবদিহি করতে বাধ্য। আবার সাংসদদেরও ভোটারদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। অনেক দেশে জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা আছে। নবম সংসদ পর্যন্ত ভোটের অধিকার নিশ্চিত ছিল বলে ভোটাররা মধ্য মেয়াদে কাউকে প্রত্যাহার করতে না পারলেও মেয়াদ শেষে সাফ জবাব দিতে পারতেন। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের বিপরীতমুখী ফল তার প্রমাণ। 

দশম সংসদ নির্বাচনের পর কেউ মনে করেন না ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তারা নির্বাচনে এলে নাকি সমানে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি আসার পরও কেন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না? কেন বিএনপির আসনসংখ্যা দশকের ঘরে পৌঁছাল না (৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি জোট পেয়েছে মাত্র ৭টি) সেই প্রশ্নের জবাব নেই। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে—এই ভয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা এখন একটি কথাও বলেননি। 

টিআইবির গবেষণামতে, দশম জাতীয় সংসদে একটি বিল পাস হতে গড়ে সময় লেগেছে ৩১ মিনিট। ২১ থেকে ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে পাস হয়েছে ৪৫ শতাংশ বিল। ৮ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লেগেছে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। ৪৬ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লেগেছে ১ থেকে ২০ মিনিট। আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়েছে ১২ শতাংশ সময়। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এক মিনিটেও বিল পাস হয়। আইন প্রণয়নে আমাদের সাংসদেরা মাত্র ১২ শতাংশ সময় ব্যয় করেন। অথচ যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় ৪৮ শতাংশ সময় এবং ভারতের লোকসভায় এই হার ৩২ শতাংশ। দশম সংসদে ১৯৩টি বিল পাস হলেও কোনো বেসরকারি বিল পাস হয়নি। ১৬টি বেসরকারি বিল উত্থাপিত হয়েছিল। 

এই সংসদে যে বিলটি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত—ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল, সেটি পাসের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে সরকার ছাত্র-তরুণদের দাবির মুখে সড়ক পরিবহন নামে যে বিলটি পাস করেছিল, সেটি অকার্যকর হয়ে আছে। পরিবহন খাতের মাফিয়া চক্র এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। যাত্রী ও সরকার উভয়ই তাদের হাতে জিম্মি। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদান রেগুলেশন বিলে এমন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে বেসরকারি সংস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে। 

সাংসদদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু সেই আইনের বিষয়ে কতজন সাংসদ আগ্রহী বা ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন, সে বিষয়ে টিআইবি কিছু না বললেও জনগণ কমবেশি জানে। নব্বইয়ের দশকে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার প্রথম যখন সরাসরি সংসদের ধারা বিবরণী প্রচার করত, তখন মানুষ বলতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। এখন তারা ফিরেও তাকায় না। আমাদের মাননীয় সাংসদেরা যে কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন, এ জন্য তাঁরা ধন্যবাদ পেতে পারেন। 

টিআইবি বলেছে, প্রতি কার্যদিবসে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে নারী সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৭১ শতাংশ এবং পুরুষের ৬২ শতাংশ। ৭৫ শতাংশের বেশি কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন সরকারি দলের ৩১ শতাংশ সদস্য এবং বিরোধী দলের ৩১ শতাংশ। সংসদ নেতার উপস্থিতি ছিল ৮২ শতাংশ কার্যদিবসে এবং বিরোধীদলীয় নেতার ৫৯ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ২৮ মিনিট করে কোরাম সংকট ছিল। এই হিসাব আগের সংসদের তুলনায় কিছুটা কম। সব মিলিয়ে ২৩টি অধিবেশনে কোরাম সংকটে কেটেছে মোট ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, যার প্রাক্কলিত অর্থমূল্য ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৩ টাকা। আসলে আমাদের সংসদে এখন যঁারা আসেন, তঁাদের অধিকাংশের মূল কাজ আর আইন প্রণয়ন নয়। সাংসদের পদটি ব্যবহার করে
বিনা শুল্কের গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটসহ নানা রকম রাষ্ট্রীয় সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া। তাঁরা সংসদে যেতে আগ্রহী হবেন কেন? 

জনগণের প্রতিনিধি হয়ে জনগণের অর্থের অপচয় যাঁরা করেছেন, তাঁদের জবাবদিহির মধ্যে আনার উপায় কী? সংসদের হুইপরা সাংসদদের উপস্থিতির বিষয়ে সজাগ করে থাকেন। কিন্তু যে সংসদে গড়ে ৩১ মিনিটে বিল পাস হয়, সেই সংসদে কথা বলার সুযোগ থাকে না। হাত তুলে হ্যঁা জয়যুক্ত করা ছাড়া কারও কোনো কাজ থাকে না। এ রকম সংসদ আর দলীয় সভার মধ্যে ফারাক করা কঠিন। তদুপরি সব সময় ৭০ ধারা মাথার ওপর ঝুলছে। দলের বাইরে কিছু বললেই ‘গর্দান’ যাবে। নবম সংসদ পর্যন্ত বিরোধী দল অধিবেশন বর্জন করলেও সংসদীয় কমিটির বৈঠকগুলো ঠিকমতো হতো। দশম সংসদে সেটিও হয়নি। বিধি অনুযায়ী ৫০টি সংসদীয় কমিটির প্রতি মাসে একটি করে মোট ৩ হাজারটি সভা করার কথা। বাস্তবে ৪৮টি কমিটি ১ হাজার ৫৬৬টি সভা করেছে। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি ও বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত কমিটির কোনো বৈঠকই হয়নি। আটটি কমিটিতে সভাপতিসহ সদস্যদের কমিটি-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ছিল। এটি সংসদীয় কার্যবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। 

টিআইবি বলেছে, প্রধান একটি দল নির্বাচন বর্জন করায় দশম সংসদ প্রতিনিধিত্বশীল হয়নি। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং তাদের প্রতিনিধিরা সংসদেও গেছেন। কিন্তু দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল যে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া দশম সংসদ নির্বাচনের চেয়েও একাদশ সংসদ নির্বাচন খারাপ হয়েছে। 

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতারা যেভাবে রই রই করে উঠেছেন, তাতে সেই বাংলা প্রবাদটির কথাই মনে পড়ে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’ একজন মন্ত্রী বলেছেন, টিআইবি একপেশে তথ্য দিয়েছে। অতীতের ভুলের জন্য টিআইবির ক্ষমা চাওয়া উচিত। দলের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, ৩১ মিনিটে আইন পাস হওয়ায় প্রমাণ করে না যে জাতীয় সংসদ অকার্যকর। তাহলে কখন সংসদ অকার্যকর হয়, দয়া করে বলবেন কি? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি