গোয়াইনঘাটের বাঁধ

সিলেটের গোয়াইনঘাটের নদী-হাওরবেষ্টিত তিনটি গ্রামের এক হাজার মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে গিয়ে একটি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাঁধের ভাটি এলাকার ৩৪টি হাওরসংলগ্ন ৩৫ গ্রামের লক্ষাধিক বাসিন্দা তাতে অসুবিধায় পড়েছে। এখন এই ভাবনা খুব সহজ যে সংখ্যাগরিষ্ঠের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় বাঁধটি ভেঙে দেওয়া। কিন্তু আমরা মনে করি, বাঁধটি ভেঙে ফেলার আগে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে ওই অঞ্চলের সামগ্রিক দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে এমন কোনো পথ বের করার চেষ্টা করা, যাতে সবার স্বার্থই রক্ষা করা যায়। তিনটি গ্রামের মানুষের যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা দূর করার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি অন্য ৩৫ গ্রামের বাসিন্দারা যাতে দুর্ভোগে না পড়ে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। 

এটা লক্ষণীয় যে তিন গ্রামের মানুষ যুগের পর যুগ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কার্যত একটি ছিটমহল-জীবন যাপন করে চলছিল। রাষ্ট্র তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে উদাসীন থেকেছে। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম নৌকাভিত্তিক যোগাযোগের ওপরই নির্ভরশীল থেকেছে। মানুষ ভেবেছে, এটাই তাদের নিয়তি। কিন্তু পুঞ্জীভূত বঞ্চনা তাদের সৃজনশীল ও উদ্যমী করেছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ এবং গ্রামবাসী মিলে প্রায় ৫০ লাখ টাকার একটি তহবিল গড়েছে। আমরা নীতিগতভাবে এই স্থানীয় উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ, তারা সরকারের মুখাপেক্ষী না থাকার উদাহরণ তৈরি করেছে। ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁধটি তৈরির পর ওই গ্রাম তিনটিতে নতুন এক প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গণপরিবহনের সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেছে। তাই আমরা বলি, বাঁধটি যদি বিজ্ঞানসম্মত ও সুপরিকল্পনাপ্রসূত হয়, তাহলে তাকে যথাসম্ভব টিকিয়ে রাখাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, আশপাশের সর্বত্র যোগাযোগ আছে, কিন্তু তিনটি গ্রামই ছিল ব্যতিক্রম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা বাঁধ অপসারণ না করে স্লুইসগেট নির্মাণের বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা মনে করি, বাঁধটি ভেঙে ফেলার আগে সরকারের উচিত হবে স্লুইসগেট নির্মাণসহ সম্ভাব্য বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখা।

তবে ওপরে উল্লিখিত আমাদের মনোভাব সত্ত্বেও প্রশাসনের উচিত হবে ওই একটি বাঁধ নির্মাণের ফলে ৩৪টি হাওরের সুযোগ-সুবিধা বরবাদ হওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা অবিলম্বে বিবেচনায় নেওয়া। কারণ, তিনটি গ্রামের স্বার্থরক্ষার যুক্তি যতই বৈধ বা যুক্তিসংগত হোক না কেন, লক্ষাধিক মানুষের জীবন–জীবিকা এবং জীববৈচিত্র্য যদি সত্যিই আলোচ্য বাঁধের কারণে বিপন্ন হয়, তাহলে উপযুক্ত বিকল্প বের করার আগে বাঁধটি অপসারণ করার বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। নদী রক্ষা কমিশন ও পরিবেশ বিভাগের কর্মকর্তারা এলাকাটি পরিদর্শন করে সরকারের কাছে অবিলম্বে যথাযথ সুপারিশ পেশ করতে পারে।