মার্কিন-পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারত-পাকিস্তান

গত মাসে আফগান–মার্কিন শান্তি আলোচনা শুরুর ঠিক আগে আগেই কাবুলে বোমা হামলায় নিহত হয় অনেকে। এর পরেও তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ছবি: এএফপি
গত মাসে আফগান–মার্কিন শান্তি আলোচনা শুরুর ঠিক আগে আগেই কাবুলে বোমা হামলায় নিহত হয় অনেকে। এর পরেও তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ছবি: এএফপি

তুমুল নাটকীয় অবস্থায় আছে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান শান্তি আলোচনা। প্রায় দুই দশকের যুদ্ধ শেষে যখন উভয় পক্ষই শান্তির পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে, তখনই কাবুলে বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হলো। আফগানরা স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওই দিন মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের চূড়ান্ত ঘোষণাও দেওয়ার কথা ছিল। এসব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় চলে আসে আইসিসের নামে আত্মঘাতী হামলা। শঙ্কা জেগেছিল, এই বুঝি আলোচনা ভেঙে গেল। কিন্তু না, আলোচনা এখনো অব্যাহত আছে। তালেবানদের মুখপাত্র সোহাইল শাহিন গত বুধবার বলেছেন, ‘শান্তিচুক্তির খুব কাছাকাছি আমরা।’

বোঝাই যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান সমঝোতার বিষয়ে আগ্রহী। কাবুলে রক্তক্ষয়ী হামলার পরও যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা বাতিল করেনি। তালেবান নেতার ভাইকে হত্যার পরও তালেবানরা জানিয়েছে, আলোচনা চলবে। যদি না কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় বা মনোভাবের পরিবর্তন না ঘটে, তবে শেষ পর্যন্ত শান্তিচুক্তি হতে পারে। মূলত, যুদ্ধপরবর্তী ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়টিই আলোচনা হচ্ছে। আফগানিস্তানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এখনো তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। ভবিষ্যতের আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতার কতটা ভাগ পাবে বা বর্তমান আফগান রাজনৈতিক কাঠামো কী ধরনের হবে, এসব নিয়ে দর-কষাকষি হচ্ছে। এমন কথাও প্রচলিত আছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলে তালেবানরা দ্রুতই কাবুল দখল করে ফেলতে পারে। আলোচনায় উভয় পক্ষই মনে হয় যুদ্ধ এড়িয়ে ভবিষ্যৎ আফগান রাজনীতির কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।

কাবুলে আত্মঘাতী হামলার পর প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে যে আলোচনা ভেঙে গেলে কারা লাভবান হবে বেশি। শান্তিকে কারা পেছন থেকে আঘাত করছে। ১৮ বছরের যুদ্ধে আফগান মানবজমিনে এখনো ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। কাবুল নদীতে এখনো রক্তের ধারা দেখা যায়।

এমন এক সময় কাবুলে বোমা হামলা হয়েছে, যখন কাশ্মীর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বেশ গরম। ভারত কাশ্মীরকে কার্যত কারফিউ রাজ্যে পরিণত করেছে। কাশ্মীর সংকটে কি মার্কিন-তালেবান আলোচনা বা কাবুলের বোমা হামলা কোনো প্রভাব ফেলতে পারে বা কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? মার্কিন-তালেবান আলোচনার পরিণতি কি কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?

আফগান যুদ্ধে সরাসরি তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো লিপ্ত থাকলেও অন্যান্য দেশ পরোক্ষে জড়িত। বড় শক্তি হিসেবে রাশিয়া, চীন, ইরান ও ভারতের স্বার্থও আফগানিস্তানে কারা ক্ষমতায় থাকবে তার ওপর নির্ভরশীল। চীন ও রাশিয়া আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার ও বাণিজ্যিক কারণে আফগানিস্তানের বিষয়ে আগ্রহী হলেও ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও এখানে বিবেচ্য।

পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতময় সম্পর্ক এবং কাশ্মীর সংকটের কারণে আফগানিস্তানের ভূরাজনীতিতে ভারতও গুরুত্বপূর্ণ হিস্যাদার। আফগান সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এই মুহূর্তে খুবই উষ্ণ। ভারত আফগানিস্তানকে দুই বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা করছে। বিভিন্ন স্থানে কনস্যুলেট খুলেছে। আফগান পুলিশ, সামরিক ও গোয়েন্দা সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আদর্শ বা মানবিক জায়গা থেকে ভারত আফগানিস্তানকে সহায়তা করছে না। বরং কাবুলে ইসলামাবাদের প্রভাব হ্রাসের জন্য নয়াদিল্লির সহায়তা বাড়ছে। তবে তালেবানরা বরাবরই ভারতের উপস্থিতিকে মেনে নেয়নি। আফগানিস্তানে ভারতের বেসামরিক অপারেশন নির্বিঘ্ন ছিল না মোটেও। ২০০৫ সালে ভারতের উন্নয়নকর্মীদের অপহরণ, দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলা করেছে তালেবানরা।

তালেবানদের এড়িয়েই ভারত আফগানিস্তানে প্রবেশের চেষ্টা করেছ, যেখানে ইরান, রাশিয়া ও চীন তালেবানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। পাকিস্তান তো তালেবানদের স্রষ্টা। আফগান–নীতিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অনুগামী ছিল। কিন্তু তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা শুরুর পর ভারতে কি আফগান রাজনীতিতে মিত্রহীন হয়ে পড়ছে? যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে ভারত সেখানে একা হয়ে পড়বে। এদিকে আলোচনা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো বিকল্প নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই আলোচনাকে খুবই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন।

জটিল ভূরাজনীতির কারণে ভারত সম্ভবত আরও একবার আফগান–নীতিতে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে ভারত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহকে সমর্থন করেছে। ১৯৮৮ সালে ভারতের এক্সটার্নাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান এ কে ভার্মা ততকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিশ্চিত করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় নজিবুল্লাহ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকবেন। সোভিয়েতের পতনের পর ১৯৯২ সালে নর্দান অ্যালায়েন্স কাবুল দখল করলে ভারত তাদের স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তালেবানরা পাকিস্তানের সমর্থনে নর্দান অ্যালায়েন্সকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে ভারত বৈরী হয়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানভিত্তিক তালেবানরা ভারতীয় যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে কান্দাহার নিয়ে যায়। জইশ–ই–মুহাম্মদ নেতা মাসুদ আজহারের মুক্তির বিনিময়ে বিমানসহ যাত্রীদের ছেড়ে দেয় তালেবানরা।

আফগানিস্তানে যদি আবার তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসে বা ক্ষমতার ভাগ পায়, তবে তা হবে ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধের ব্যাপার। তালেবানদের আবার ক্ষমতায় ফেরা বিজয় হিসেবেই গণ্য হবে। পাকিস্তানিও তখন কাশ্মীরের দিকে মন দিতে সক্ষম হবে, যেহেতু তার পেছনে থাকবে আফগান সমর্থন ও লোকবল।

তাই কাবুলে তালেবানদের ফেরা কখনোই ভারতের জন্য স্বস্তির হবে না; বরং আফগানিস্তানে পাকিস্তানবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় থাকলে উভয় সীমান্তে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে পারবে ভারত। কিন্তু যদি তা না হয়, উল্টো ভারতই চাপে পড়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদির সরকার তখন কাশ্মীর নিয়ে বড় ধরনের মুশকিলে পড়তে পারে। তখন কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করার যে ধূম্রজাল ভারত তৈরি করেছে, তা আর করতে পারবে না।

সর্বশেষ, শান্তি আলোচনায় উভয় পক্ষ আশাবাদী হলেও বেশ কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে হবে চুক্তিতে। মূলত, শীর্ষ ছয় তালেবান নেতা আলোচনায় আসছেন। তালেবানদের অনেক সাধারণ যোদ্ধাই জানে না আলোচনায় কী হচ্ছে। এমনকি তারা যুদ্ধ করে মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেওয়ার পক্ষে। তাই এখনো অনেক কিছু মীমাংসা করার বাকি। আগামী মাসে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচনকে ঘিরে আফগান নীতিনির্ধারকেরা দ্বিধাবিভক্ত। এক পক্ষ চাইছে শান্তি আলোচনার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দিতে, অপর পক্ষ নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠানের পক্ষে। এ অবস্থায় নানা পক্ষ সক্রিয় হতে পারে শান্তি আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার জন্য। এখনো আফগানিস্তানে আল–কায়েদা ও আইসিসের পদচিহ্ন রয়েছে। তবে বোমা হামলার দায় আইসিস স্বীকার করলেও এ থেকে তাদের লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই; বরং লাভ হবে অন্য কোনো পক্ষের। ফায়দা হবে সেই পক্ষের, যারা চায় না আফগানিস্তানে শান্তি ফিরে আসুক, যারা আফগানিস্তানের আগুনে আলু পুড়িয়ে খেতে চায়।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন