লাখো 'বিদেশি'কে কোথায় রাখবে আসাম?

রাত পোহালেই যাঁরা ‘বিদেশি’ ঘোষিত হলেন, তাঁদের দুর্ভাগ্যের শেষ কোথায়? ছবি: এএফপি
রাত পোহালেই যাঁরা ‘বিদেশি’ ঘোষিত হলেন, তাঁদের দুর্ভাগ্যের শেষ কোথায়? ছবি: এএফপি

আসামে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন বা এনআরসি থেকে বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব এখন স্থানীয় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলোর ওপর বর্তাবে। যাঁরাই বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন করবেন, তাঁদের যেতে হবে এই ধরনের ট্রাইব্যুনালে। অর্থাৎ এনআরসির মূল রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে এখন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১৯৬৪ সালের এক আইন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলোর আইনগত ভিত্তি।

প্রতি ৩০০ বর্গমাইলে একটা করে ট্রাইব্যুনাল?
আসামে ইতিমধ্যে ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। আসামের আয়তন ৩০ হাজার ২৮৫ বর্গমাইল। অর্থাৎ প্রতি তিন শ বর্গমাইলে সেখানে একটা করে আদালত কাজ করছেন মুখ্যত বাংলাভাষী ‘অবৈধ’ ভোটারদের জন্য। আরও ২০০ ট্রাইব্যুনাল এ মাস থেকেই কাজ করতে যাচ্ছেন। আসাম সরকারের পরিকল্পনা হলো মোট এক হাজার ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হবে সেখানে। তাতে করে রাজ্যটির প্রতি বর্গমাইলে একটা করে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বসবে। বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত হিসাবে এটা হবে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

ট্রাইব্যুনালগুলোয় রাজ্য সরকারের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ
আসামে আরও নজিরবিহীন হলো, এই ট্রাইব্যুনালগুলোর প্রতি জন–আস্থার ঘাটতি। আইনজীবী এবং তাঁদের মক্কেলÑউভয় তরফে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো নিয়ে রয়েছে বিস্তর অনুযোগ। কাজ বিচার হলেও আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের ওপর সরকারের দৃঢ় ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর কারণেই তার কাজে রয়েছে জন–আস্থার সংকট। প্রশাসনিকভাবেই ট্রাইব্যুনালগুলোয় আসাম সরকারের প্রভাব কাজ করছে। অতীতে অনেক সদস্যকে তাঁদের ‘অদক্ষতা’র কথা বলে বাদ দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনাল থেকে। সে কারণে ট্রাইব্যুনালের কাজে বিজেপি ও অসমীয় রাজনীতিবিদদের প্রভাব থাকাও একটা বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মানুষ মনে করে।

ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনালের যেসব সদস্যকে রাজ্য সরকার বাদ দিয়েছে, তাঁদের ‘দক্ষতা’র মূল্যায়ন করা হয়েছে কতজন বাসিন্দাকে তাঁরা মোট কার্যকালে ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, তার ভিত্তিতে। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালে নতুন করে ২২১ জন সদস্য নিয়োগকালে দেখা যায়, তাঁদের নিয়োগ শর্তেও ব্যাপক আপস করা হয়েছে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদেরও ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। অথচ আগে বিচারিক কাজে অভিজ্ঞতা একটা প্রধান শর্ত হিসেবে ছিল।

বেনাগরিক বিদেশিদের রাখতে দরকার শত শত ডিটেনশন সেন্টার
নিয়ম রয়েছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের নামে নোটিশ যাবে এবং তাঁরা নির্দিষ্ট দিনে ট্রাইব্যুনালে হাজির হবেন। এরূপ হাজিরার পর সরকারি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদনের জন্য ১২০ দিন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে এটা দুই মাস ছিল। সম্প্রতি এই আইনে সংশোধন করা হয়েছে।

পুনর্বিবেচনার আবেদনের সময় বাসিন্দারা সচরাচর ভোটার তালিকার কপিগুলো দিয়ে থাকেন, যেখানে তাঁর বা তাঁদের পরিবারের নিকটজনের নাম ছিল বা আছে। এ ছাড়া বসবাসের সপক্ষে, নাম, পিতা-মাতার পরিচয় ইত্যাদি বিষয়েও অনেক ধরনের সনদ জমা দিতে হয় ট্রাইব্যুনালে। এই নথিগুলোর ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল চূড়ান্ত মতামত দিয়ে থাকেন। অনেক সময় লাগে এই প্রক্রিয়ায়। ট্রাইব্যুনালের বিবেচনা শেষ পর্যন্ত কেউ যদি বেনাগরিক বিবেচিত হয়ে যান, তখন তাঁর জন্য নির্ধারিত স্থান হবে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। এগুলোর পরিবেশ কারাগারতুল্য।

এ ক্ষেত্রেও আসামে এক সম্ভাব্য নজিরবিহীন অবস্থা অপেক্ষা করছে। ১৯ লাখ মানুষের অর্ধেকও যদি শেষ বিচারে বিদেশি বেনাগরিক সাব্যস্ত হয়ে যান, তাহলে এত মানুষকে রাখার মতো ডিটেনশন ক্যাম্প আসাম কোথায় পাবে,Ñসে প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। ছয়টি ডিটেনশন সেন্টারসহ আসামে কারাগার রয়েছে ৩১টি। এগুলোর ধারণক্ষমতা ৮ হাজার ৯৩৮ জন। এরই মধ্যে সেখানে ১০ হাজারের অধিক বন্দী অবস্থান করছে। ডিটেনশন সেন্টারগুলোয় কোনো ফৌজদারি অপরাধ না করেও বর্তমান আইনে একজন বন্দী সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত আটক থাকতে পারেন।

আইনগতভাবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে বিদেশি সাব্যস্ত ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সর্বশেষ স্তর হলো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। তবে সেখানে একটা মোকদ্দমা পেশ করতে কাগজপত্র তৈরির প্রক্রিয়ায় অন্তত দেড় মাস সময় লেখে যায়। এই সময়টিতে ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষিত প্রত্যেক বেনাগরিককে যদি ডিটেনশন সেন্টারে রাখতে হয়, তাহলে আসামকে আসন্ন দিনগুলোয় শত শত কারাগারতুল্য কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রশ্ন উঠেছে, সেটা কতটা সম্ভব?

আলতাফ পারভেজ: গবেষক