অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ

সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে কোনো নাগরিক গৃহহীন থাকবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তিতে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত ১৬ জুন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছিলেন, ঢাকা শহরে ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তিতে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫ জন লোক বাস করছে। এই হিসাব ২০১৪ সালের। গত পাঁচ বছরে ঢাকার জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে। দেশের অন্যান্য শহরেও ছোট–বড় অনেক বস্তি আছে এবং সেখানকার বাসিন্দারাও জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সুস্থ ও সুষম নয়। যে হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সেই হারে দারিদ্র্য কমছে না। গ্রামের দরিদ্রদের চেয়ে শহরের দরিদ্রদের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিপুলসংখ্যক বস্তিবাসীর প্রয়োজনীয় পরিষেবা যথা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের আইনানুগ ব্যবস্থা নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নিতে হলে স্থায়ী বাসস্থান থাকা প্রয়োজন, যা কোনো বস্তিবাসীর থাকে না।

এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বস্তিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে যে সিন্ডিকেট বা চক্র গড়ে উঠেছে, তারাই সেখানে বেআইনিভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ সরকারি কোষাগারে কোনো অর্থ জমা পড়ছে না। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার তিনটি প্রধান বস্তি মহাখালীর কড়াইল ও মিরপুরের ভাষানটেক ও চালানটিকা বস্তি ঘিরে ২৪টি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা এসব বস্তির বাসিন্দাদের কাছ থেকে মাসে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা আদায় করে থাকে। অনেক সময় তারা বস্তিবাসীদের মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কাজেও নিয়োগ করে থাকে। 

কেবল ওই তিন বড় বস্তি নয়, ঢাকার প্রতিটি বস্তির বাসিন্দারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি তথা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। তাদের এই জিম্মিদশা যে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক রূপনগর বস্তির অগ্নিকাণ্ড, যাতে সেখানে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে বস্তিবাসীরা এখন খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। তদন্তে জানা গেছে, অবৈধ গ্যাস–সংযোগ থেকেই অগ্নিকাণ্ডের উৎপত্তি। সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাস–সংযোগ বিপজ্জনক হলেও সিন্ডিকেট সেটাই করে থাকে। একইভাবে বস্তিতে বিদ্যুৎ–সংযোগও নেওয়া হয় অবৈধভাবে। ২০১৭ সালে কড়াইল বস্তিতে আগুন লেগে যে ৫২৬টি ঘর পুড়ে যায়, তা–ও ঘটেছিল ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস–সংযোগ থেকে। 

ঢাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি বা ডেসকো বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগের কথা স্বীকারই করছে না। যদিও একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাঁরা সেটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। যদি অবৈধ বিদ্যুৎ–সংযোগই দেওয়া না হয়, তাহলে বিচ্ছিন্ন করার প্রশ্ন আসে কেন? 

আসলে এরা সমস্যাটি দেখেও না দেখার ভান করছে। মাঝখান থেকে ফাউ কামিয়ে নিচ্ছে তথাকথিত সিন্ডিকেট। ফলে প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে হচ্ছে সেখানকার বাসিন্দাদের। বস্তি পুড়লেও সিন্ডিকেটের লাভ। তারা নতুন ঘর তোলার নামে ফের সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষগুলোর কাছ থেকে নতুন করে অর্থ আদায় করতে পারে। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার নামে বস্তিবাসীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া কিংবা সর্বস্বান্ত করার অধিকার কারও নেই। বস্তিগুলোর পরিষেবার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।