নাগরিকপঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়

ভারতের আসামের ১৯ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকাবহির্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে
ভারতের আসামের ১৯ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকাবহির্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে

ভারতের শাসক দল বিজেপির প্রধান অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, আসামের ৪০ লাখ বহিরাগতকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। এরা ঘুণপোকার মতো, আমাদের দেশকে এরা ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এসব বহিরাগত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এরা সন্ত্রাসী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে সাওয়াই মধুপুরের এক জনসভায় অমিত শাহ ঘোষণা করেন, প্রতিটি বহিরাগতকে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘বিজেপি সরকার এক এক ঘুসপাইথিয়েকো চুন চুন কার মাতদাতা সুচি সে হাটানে কা কাম কারেগা’—তিনি কয়েক হাজার উৎফুল্ল বিজেপি সমর্থকের কাছে প্রতিশ্রুতি দেন।

অমিত শাহ ও বিজেপি সরকার সেই প্রতিশ্রুতি রাখার কাজে আরও এক কদম এগিয়ে গেল। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নাগরিক তালিকা (নাগরিকপঞ্জি) বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আসামের ১৯ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকাবহির্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগে ভাবা হয়েছিল প্রায় ৪০ লাখ লোক এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে যাওয়াতে বিজেপির অনেক নেতা অখুশি। আসামের বিজেপির প্রধান বলেছেন, ‘অপেক্ষা করুন, এটাই শেষ কথা নয়। প্রতিটি বহিরাগতকে বের না করা পর্যন্ত আমরা থামব না।’

বহিরাগতদের ঘুণপোকা বা নোংরা জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা এই প্রথম নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বহিরাগতদের ‘ধর্ষকামী’ ও ‘মাদক ব্যবসায়ী’ বলে ঢালাও ঘোষণা করেছিলেন। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ওরবান বহিরাগতদের ‘পয়জন’ বা বিষের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মিয়ানমারের সামরিক প্রধান ‘বহিরাগত’ রোহিঙ্গা মেয়েদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এরা এতটাই নোংরা ও কুৎসিত যে বর্মি সেনাসদস্যরা তাদের ধর্ষণেও আগ্রহী নয়। যুক্তরাজ্যের রাজনীতিক নাইজেল ফারাজ সাবধান করে দিয়েছেন, বহিরাগতদের তাড়ানো না গেলে ইউরোপে ইসলামি সন্ত্রাসীরা ‘জিহাদ’ শুরু করবে।

সোজা কথায়, বহিরাগত তা উদ্বাস্তু হোক অথবা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী—এরা কেউই ঠিক মানুষ নয়। মানুষ হিসেবে কোনো অধিকার বা মর্যাদা এরা দাবি করতে পারে না। বহিরাগতরা এসে আমাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চরিত্র বদলে ফেলছে। অতএব এদের ঠেকাতে হবে। এই ভীতিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একদল রাজনীতিক নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। তঁাদের অভিবাসীবিরোধী অতি-গরম কথাবার্তা কাজে লেগেছে। ট্রাম্প ও ওরবানের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে এই অভিবাসনবিরোধিতা।

ভারতের বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির সাফল্য এই ধারার ভিন্ন কিছু নয়। মোদি কার্যত এমন এক হিন্দু ভারত নির্মাণ করতে চান, যেখানে নাগরিক হিসেবে সব অধিকার ভোগ করবে শুধু হিন্দুরা। বহিরাগত যদি হিন্দু হয়, তাদের ব্যাপারেও মোদি সরকারের আপত্তি নেই। যত আপত্তি মুসলিমদের ব্যাপারে। বিজেপি সরকার কোনো রাখঢাক ছাড়াই ঘোষণা করেছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান ভারতে আশ্রয় পাবে, কিন্তু মুসলিমরা নয়। কোনোই সন্দেহ নেই, এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একমাত্র লক্ষ্য মুসলিমবিরোধী মনোভাব চাঙা করে তা নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার। শত শত বছর ভারতে বাস করেও মুসলিমরা সে দেশে এখনো ‘বহিরাগত’। একুশ দশকে এসেও ‘অপরে’র প্রতি ভীতির চেয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক অস্ত্র নেই, মোদি-ট্রাম্প-ওরবানদের সাফল্য দেখে সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

অভিবাসী তা বৈধ হোক অথবা অবৈধ—প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট নাগরিক অধিকার রয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, যার অধীনে অভিবাসীর অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত এক সিদ্ধান্তে সব সদস্যরাষ্ট্রকে অভিবাসীর মানবাধিকারের সংরক্ষণের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহিরাগত শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণে সব সদস্যরাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় সংবিধানেও অভিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেমন ভারতীয় শাসনতন্ত্রের ১৪তম ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘দ্য স্টেট শ্যাল নট ডিনাই টু অ্যানি পারসন ইকুয়ালিটি বিফোর দ্য ল অর দ্য ইকুয়াল প্রোটেকশন অব দ্য লস উইদিন দ্য টেরিটরি অব ইন্ডিয়া।’ অর্থাৎ ভারতের সীমানার অন্তর্গত কাউকে আইনের চোখে সমানাধিকার ও সে অধিকারের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

ঠিক সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যেই বিজেপি সরকার জাতীয় নাগরিক তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি বহিরাগতকে ‘চুন চুন কার হাটানো’র যে প্রতিশ্রুতি বিজেপির প্রধান দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন শুরু হলে এদের ঠেলে পাঠানো হবে কোথায়? অনুমান করি, অমিত শাহর হুমকির লক্ষ্য বাংলাদেশ। ভারতকে কোনোভাবেই চটানো যাবে না, এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার এ প্রশ্নে কার্যত মুখ বুজে থাকার পথ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ, অতএব এ নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। এমনকি বুদ্ধিজীবী-কলাম লেখকেরাও ব্যাপারটাকে ভারতের নিজস্ব ব্যাপার বলে এড়িয়ে গেছেন।

কিন্তু যেখানে কয়েক লাখ মানুষের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকার জড়িত, তা কী করে কোনো এক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়? এই একই যুক্তি দেখিয়ে তো রোহিঙ্গাদের মেরে-পিটিয়ে লাশ করা হলেও ‘এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে মিয়ানমার পার পেয়ে যেতে পারে। চীন হাজার হাজার উইঘুর মুসলিমকে ‘শুদ্ধীকরণের’ নামে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢুকিয়েছে। সেটিও তাহলে চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে কয়েক হাজার উদ্বাস্তুকে নিজের দেশে না রেখে ঠেলে পাঠিয়েছে পাপুয়া নিউ গিনিতে। সেটিও তাহলে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানও বলেছিল জাতীয় নিরাপত্তার নামে যে সামরিক ব্যবস্থা তারা নিয়েছে, সেটি একান্তই তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

না, আন্তর্জাতিক আইনের চোখে এই যুক্তির কোনোটাই ধোপে টেকে না। নিজ সীমান্ত এলাকায় প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও সমুন্নতকরণ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অপরিহার্য উপাদান। গত শতাব্দীর সত্তর দশকে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা ও বলকানে যে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়, তারই প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নতুন মানবাধিকার বর্ম নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এই বর্মের নাম ‘রাইট টু প্রটেক্ট’ বা R2P—যার অধীনে নিজ দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের। কোনো সরকার যখন সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপের পূর্ণ অধিকার রাখে।

আসামের ক্ষেত্রে যে ১৯ লাখ মানুষকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক অশনিসংকেত। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এক বিশ্লেষণে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, যাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হলো, তাদের অধিকাংশই হিন্দু। অতএব ভয়ের কিছু নেই। মুসলিম বলে যাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন না, তাঁদের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেওয়া হবে। ফলে আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই।

যঁারা উদ্বেগ নেই বলে আমাদের আশ্বস্ত করতে চাইছেন, তঁাদের আমি অমিত শাহর ‘চুন চুন করকে হাটায়ে গা’ কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই। যারা এই তালিকাভুক্ত হয়েছে, তারা কেবল আইনত অবৈধ বলেই চিহ্নিত হবে না, সামাজিকভাবে দৈনিক নিগ্রহের সম্মুখীন হবে। হিটলারের জার্মানিতে একসময় ইহুদিদের বুকে পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি ইহুদি, অতএব তোমার জন্য সরকারি চাকরি নেই, তুমি বাড়িভাড়া পাবে না, তোমার ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। আসামেও ঠিক সেই ঘটনাই ঘটতে পারে। তুমি ঘুণপোকা, অতএব তুমি বের হও। যতক্ষণ তুমি বের না হচ্ছ, আমরা তোমাকে যেভাবে সম্ভব লাঞ্ছিত করব।

আজকের আমেরিকার অবস্থা দেখুন। অবৈধ বহিরাগত—এ অভিযোগে হাজার হাজার মানুষকে ঘর থেকে টেনে বের করা হচ্ছে। স্ত্রী অথবা সন্তানেরা বৈধ, অতএব তারা এ দেশে থেকে যেতে পারে। কিন্তু পরিবারের যিনি প্রধান, ৩০ বছর ধরে যে জীবন তিনি নির্মাণ করেছেন, যে দেশের জন্য নিজের শ্রম ও মেধা দিয়েছেন—সবকিছু উপেক্ষা করে হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। পাঠানো হচ্ছে এমন এক দেশে, যার সঙ্গে তাঁর কার্যত আর কোনো সংস্রবই নেই। জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক কোনো আইনেই এমন ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমর্থন মেলে না।

তবে, শুধু আইনের কথা বলে বহিরাগতদের অধিকারের এই লঙ্ঘন ঠেকানো সম্ভব হবে না। রাজনীতিকদের প্রতি আবেদন-নিবেদনেও কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিবাদ, দেশের ভেতরে ও বাইরে। আমরা আশা করব, ভারতের নাগরিক সমাজ এমন মানবেতর অপরাধে সম্মতি দেবে না। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী যাতে সেই কাজে সম্মতি না দেয়, সে জন্যও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিজেপি যদি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে বহিরাগত চিহ্নিত এসব মানুষকে ঠেলে পাঠানো হবে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা সংকট থেকে আমরা শিখেছি চুপ করে থাকলে অথবা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ওপর ভরসা করলে শেষে আমাদেরই পস্তাতে হয়। প্রতিবাদ করার তাই এখনই সময়।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি