শ্রম সবখানেই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান

আর্ল আর মিলার। ফাইল ছবি
আর্ল আর মিলার। ফাইল ছবি

শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছি আমি। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মিশিগানের ফ্লিন্টে। ফ্লিন্ট শহর গাড়ি তৈরির জন্য এতই বিখ্যাত যে একে ডাকা হতো ‘ভেহিকল সিটি’ বা ‘গাড়িনগরী’। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িশিল্পের রাজধানী হিসেবে আমার নিজের অঙ্গরাজ্য মিশিগান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গত শতকের মধ্যভাগের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির সামনের কাতারে। একই সঙ্গে ছিল এ অর্থনীতিকে জোরদার করা শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রভাগেও।

আমার বাবা জেনারেল মোটরসের একটি গাড়ি কারখানায় ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কার্সের একজন শ্রমিকনেতা হিসেবে ৩৭ বছর কাজ করেছেন। বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন, প্রত্যেক শ্রমিকের কর্মস্থলে মর্যাদা ও ন্যায়বিচার এবং ন্যায্য বেতন পাওয়া, অভিযোগ ব্যবস্থাপনার সুযোগ, নিরাপত্তাগত সুরক্ষা ও সংগঠিত হওয়া ইত্যাদির অধিকার আছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার জাতীয় শ্রমিক দিবসে ছুটির দিন পালনের মাধ্যমে দেশের কর্মীদের সম্মান জানায়। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রথম বছরটিতে বাংলাদেশের আটটি খাতের শ্রমিকদের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। তাঁদের প্রতিও আজ আমি সম্মান জানাচ্ছি। দারুণ এই দেশের নানা প্রান্তে সফরের সময় আমি তৈরি পোশাক ও ইস্পাত কারখানা, পুরোনো জাহাজ ভাঙার স্থান, কৃষি খামার ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্টে গিয়েছি। আমি বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক রিসাইক্লিং খাতে কর্মীদের বাতিল বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ক্ষুদ্র অংশ ও প্লাস্টিকের টুকরা সংগ্রহ ও বাছাই করতে দেখেছি, যাতে সেগুলো নদী-নালাগুলোয় না পড়ে নতুনভাবে ব্যবহৃত হয়। তৈরি পোশাক খাতে অল্প সময়ের নোটিশে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ পূরণ করতে যে অনন্য সমন্বয়ের মাধ্যমে এখানে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর বস্ত্রের উৎপাদন হয়, তার প্রশংসা করছি।

জীবনমান আরেকটু উন্নত করতে ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে রেখে শহরে কাজ করছেন—এমন মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই দারুণ এই দেশের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টারত কর্মীদের দৃঢ় চেতনা আর প্রাণশক্তি চোখে পড়েছে। আরও ভালো ও নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে নিয়োগকারী ও কর্মীরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যে অসাধারণ অগ্রগতি করেছেন, তা-ও দেখার সুযোগ হয়েছে আমার।

রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার অন্যতম অগ্রাধিকার হচ্ছে আমাদের দুই মহান দেশের মধ্যে ইতিমধ্যেই শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করা। আপনারা কি জানতেন যে গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে? এর প্রায় ৮৫ শতাংশের মতো এসেছে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত থেকে, যার মধ্যে রয়েছে ওভেন ও নিট পোশাক, ফুটওয়্যার ও অন্যান্য বস্ত্রসামগ্রী। আরএমজি খাতের ৪০ থেকে ৫০ লাখ কর্মীর সবাই বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অতি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে গত ছয় বছরে নিরাপত্তা ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নতির বিষয়টিও একই রকম প্রশংসনীয়। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক ব্র্যান্ডগুলো একটি প্রমিত মান গঠন এবং তাদের পণ্য প্রস্তুতকারী কারখানার কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য অর্থ বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছিল। তারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নি, কাঠামোগত ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার উন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ থেকে উত্তর আমেরিকায় যত তৈরি পোশাক আমদানি হয়, তার বেশির ভাগের সঙ্গে যুক্ত ২৯টি আন্তর্জাতিক পোশাক কোম্পানি, খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড মিলে গঠন করে ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’ নামের জোট। আরও ২২০টি আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা স্বাক্ষর করে ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’। এর লক্ষ্য ছিল নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কারখানার মালিকদের সঙ্গে কাজ করা।

প্রাথমিক পাঁচ বছরের মেয়াদে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড মিলে ৭০০টির বেশি কারখানায় জীবনের ঝুঁকির নিরাপত্তা বিষয়ে পুরোপুরি সমাধানের ব্যাপারে তদারকি করেছে, আরও ১ হাজার ৪০০টি কারখানার ঝুঁকির শতকরা ৯০ ভাগ সংস্কার করেছে এবং ৩৫০টির মতো কারখানার কাজ স্থগিত করেছে। অ্যালায়েন্স ১৬ লাখের বেশি কর্মী, ২৮ হাজার ৮৭৮ জন নিরাপত্তা প্রহরী ও কারখানার ম্যানেজারদের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অ্যালায়েন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এর সাবেক সদস্যদের কয়েকজন মিলে ‘নিরাপন’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে নিরাপন সদস্যরা পণ্য কেনেন—এ রকম ৬০০টি পোশাক কারখানার চলমান নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ও হেল্পলাইন প্রচেষ্টার ওপর নজর রাখা।

অন্যদিকে, অ্যাকর্ড তার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের আরও এক বছর সময় দিয়েছেন। ২০০টির বেশি ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত ‘ট্রানজিশন অ্যাকর্ড’ স্থানীয় একটি কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাকর্ড বাংলাদেশের কার্যক্রম হস্তান্তর করবে, যাদের সদস্য থাকবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক এবং নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা।

এই প্রশংসনীয় অগ্রগতিকে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, আমরা যদি একজোট হয়ে কাজ করা অব্যাহত রাখি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করি, তাহলে বিশ্ব একদিন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কথাটিকে মানসম্মত পণ্য আর কর্মী নিরাপত্তা ও অধিকারের স্বর্ণমান হিসেবেই বিবেচনা করতে পারবে।

আর্ল আর মিলার বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত