বাবরের মৃত্যু নতুন করে ভাবায়

খলিলুর রহমান বাবর
খলিলুর রহমান বাবর

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অভিনেতা খলিলুর রহমান বাবরকে মানুষ খলনায়ক হিসেবে চেনে। সে রকম খলনায়ক যে কিনা নায়িকাকে উত্ত্যক্ত করা ছাড়াও এহেন কু-কাম নেই, যা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। ফলে চলচ্চিত্রের খলনায়ক অজান্তেই মানুষের মনে ভীতিকর অনুভূতি এনে দেয় এবং মানুষ পর্দার সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে বাস্তবের ব্যক্তির পার্থক্য ভুলে গিয়ে বাস্তব জীবনেও খলনায়ক হিসেবেই তাঁকে ধরে নেয়। এই অনুভূতি বাবরকে অজান্তে ব্যথিত করেছিল কি না, তা আমার জানা নেই। জানা নেই কোন ভাবনায় আপ্লুত ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বিদেশে বসে যেটুকু আমি জানতে পেরেছি তা হলো, বাবরের জীবনের অন্তিম দিনগুলো ভালো যায়নি। তাঁর চিকিৎসায় সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ধরনা দেওয়া হলেও সাহায্য মেলেনি এবং শেষ পর্যন্ত অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন তিনি।

বাবর আমার পরিচিত। কৈশোর ও যৌবনের অনেকগুলো দিন আমরা কাটিয়েছি কাছাকাছি। আমরা ছিলাম ঢাকার একই পাড়ার মানুষ, একই ক্লাসের ছাত্র, যদিও আমাদের স্কুল ছিল ভিন্ন। সেই সঙ্গে পাড়াভিত্তিক সখ্যের কারণে বাবরের সঙ্গে আমার নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। হাল ফ্যাশনের পোশাক নিয়ে ওর ছিল আগ্রহ এবং সেই দিনগুলোর সঙ্গে মানানসই সাদা রঙের টেডি প্যান্ট আর গাঢ় কোনো রঙের শার্ট গায়ে চাপিয়ে পথে বের হওয়া বাবরকে দেখে তখনই মনে হয়েছিল ঢাকার ছায়াছবি ওকে টানছে।

তবে পরিবার থেকে ওর ওপর চাপ ছিল সে রকম সব দুষ্ট চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার। সেই সূত্রে আমার কাছে প্রায়ই তার আসা হতো এবং এসএসসি পরীক্ষার আগে নিজের নানা রকম নোট ওকে দিয়ে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি। পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর খুব সকালে বাবর এসেছিল আমাকে অভিনন্দন জানাতে এবং ওর ভাষ্য অনুযায়ী আমার ‘উদার সাহায্য নিয়ে’ পরীক্ষার বৈতরণি পার হওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে। লেখাপড়ার পরবর্তী ধাপে আমাদের কলেজও ছিল ভিন্ন। তবে কলেজজীবনের শুরু থেকেই বাবর একে-ওকে ধরে একসময় এফডিসিতে যাওয়া-আসা শুরু করে এবং ছোটখাটো কিছু চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও ওর মিলে যায়।

আমাদের যৌবনের সেই দিনগুলো ছিল ইতিহাসের উত্তাল এক পর্ব, সময় যখন আমাদের কাছে দাবি করেছিল তার ডাকে সাড়া দেওয়ার। বাবরও সেই দিনগুলোতে বসে থাকেনি। মিছিলে কিংবা ১৯৭১-এর মার্চ মাসের শুরুতে ঢাকার রাজপথে আমাদের ডামি রাইফেল হাতে কুচকাওয়াজে মত্ত থাকাতে ওকে দেখা না গেলেও ও যে ঘরে বসে থাকেনি, সেই খবর আমরা ঠিকই পেয়েছিলাম। তারপর আসে সেই রজনী, চারদিক জুড়ে গোলাগুলি আর ছড়িয়ে পড়া আগুনের শিখার মধ্যে বিনিদ্র রাত কাটানো অবস্থায় উদ্বিগ্ন মানুষের দলে বাবরের দেখাও আমি হঠাৎ একঝলক পেয়েছিলাম। পরে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে আসার পর আবারও বাবর এসেছিল আমাকে অভিনন্দন জানাতে। বাবরের সঙ্গে আমার যোগাযোগের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি সেখানেই। এরপর আমার যাত্রা বিদেশে এবং বাবরের যাত্রা সিনেমার জগতের আরও অনেক গভীরে।

বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর মনে হয় একবারই কেবল কোনো এক আসরে বাবরের দেখা আমি পেয়েছিলাম। বাবর তত দিনে চলচ্চিত্রজগতের বিখ্যাত মানুষ, নায়ক হিসেবে সেই জগতে প্রবেশ করার পর কীভাবে যেন খলনায়কের ভূমিকায় ও সরে যায়। সেবারের দেখায় বাবর আগের মতোই ডাকনামে আমাকে সম্বোধন করে জানতে চেয়েছিল আমার খবরাখবর। এরপর থেকে বাবর আমার জীবনে হয়ে উঠেছে সংবাদপত্রের পাতায় দেখা ছবির বন্ধু। শেষ দিকে বাবর বাংলা ছায়াছবিকে বিদায় জানালে সেই সামান্য যোগসূত্রটুকুও অবশেষে ছিঁড়ে যায়। এখন তো সেই বিচ্ছেদ স্থায়ী রূপ নিয়েছে।

বাবরের চিকিৎসা ঠিকভাবে হয়েছিল কি না, তা আমার জানা নেই। তবে তার চিকিৎসায় সহায়তা পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যে ধরনা দেওয়া হয়েছিল, তা আমি জানতে পেরেছি পত্রিকা পাঠ করে, যে বিষয়টি আমাকে পীড়িত এবং ব্যথিত করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন আর চোখের আড়ালে পড়ে থাকা কোনো সংবাদ নয়। চটকদার উন্নতি সেটা না হলেও দেশটি কিন্তু একেবারে পিছিয়ে নেই। তবে তারপরও মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার খরচ মেটানোর জন্য এর-ওর কাছে কেন হাত পাততে হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাইনি।

এ ছাড়া নিজের অথবা পরিবারের অন্য কারও চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের দেউলিয়া হয়ে পড়ার অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এটাকে কিন্তু উন্নয়ন কোনো অবস্থাতেই বলা যায় না। উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে মানবকল্যাণকে যুক্ত না করতে পারলে সেই উন্নয়ন হয়ে পড়ে অর্থহীন। আর এ কারণেই সত্যিকার অর্থে উন্নত দেশ (যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও সেই মানবকল্যাণের বিচারে এই তালিকায় ফেলতে আমি নারাজ) নাগরিকদের চিকিৎসার দিকটায় সব সময় নজর দিয়ে থাকে এবং অসুস্থ হলে কাউকে যেন নিঃস্ব হয়ে যেতে না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সে রকম অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসা সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ধরনা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমার কাছে কেন যেন মনে হয় আমাদের প্রভাবশালী মহলের একটি গোষ্ঠী হয়তো ইচ্ছা করেই এ রকম ব্যবস্থা কায়েম রেখে চলেছে, হতে পারে এ কারণে যে নিজেদের বদান্যতা প্রদর্শন এবং তা প্রচার করার সুযোগ সেটা এনে দেয়। উন্নয়নের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটাকে বলা যায় সামন্ততান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা থেকে উৎসারিত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

আমার কৈশোরের বন্ধু ও পরবর্তীকালে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাবরের মৃত্যুর পর বিষয়টি নতুন করে আমাকে ভাবিয়েছে। আমাদের ব্যয়বহুল চিকিৎসাব্যবস্থাকে কীভাবে সত্যিকার অর্থে কল্যাণমুখী করা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার নতুন সুযোগ এই মৃত্যু করে দেবে, সেটাই আমি অন্তর থেকে কামনা করছি। তাতে বাবরের মুখে অন্য জীবনেও হয়তো দেখা যাবে তৃপ্তির হাসি।

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক