আসামে এনআরসির গুমর ফাঁস

খোলা চোখে আসাম এ মুহূর্তে শান্ত। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নেই। কিন্তু গত ৪৮ ঘণ্টায় আসামে এক বিস্ময়কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গুয়াহাটির রাজনৈতিক মহল এবং সুশীল সমাজে কাউকে সুখী মনে হচ্ছে না। ডান-বামনির্বিশেষে ক্রমে এনআরসিবিরোধিতার সামাজিক পরিসর বাড়ছে। কেউ কেউ এনআরসির কপিতে আগুনও লাগাচ্ছে।

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পুঁজি ছিনতাই?
যদিও যে যার অবস্থান থেকে এই বিরোধিতায় নেমেছেন এবং একে অপরকে দোষ দিচ্ছেন; কিন্তু এই প্রথম এনআরসিতে অসন্তুষ্ট দেখা যাচ্ছে অসমিয়া রাজনীতিবিদদেরও। তাঁদের দাবি, এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি মানুষের ‘রাষ্ট্রবিহীন’ হওয়া উচিত ছিল। অসমিয়া রাজনীতিবিদেরা এত দিন ন্যূনপক্ষে প্রায় অর্ধকোটি আসামবাসীকে ‘অবৈধ’ বললেও চূড়ান্ত এনআরসির পর নিজ জাতিসত্তার মানুষদের মধ্যে তাঁদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই রাজনীতিবিদদের দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক পুঁজি ছিল অবৈধ নাগরিকত্বের বিষয়টি। এই বিষয়কে সামনে রেখেই বিজেপির সঙ্গে তাদের মৈত্রী গড়ে উঠেছিল। সেই মৈত্রী এখন বড় ধরনের ঝাঁকুনিতে দুলে উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এনআরসি অসমিয়াদের রাজনৈতিক পুঁজি ছিনতাই করে নিয়েছে।

তফসিলি ও মুসলমানদের ভয়
দুদিন ধরে হিমন্ত বিশ্বশর্মাসহ বিজেপির প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ উত্তেজক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন এনআরসির বিপক্ষে। এর কারণ স্পষ্ট। অনেক হিন্দু বাদ পড়ে গেছে চূড়ান্ত তালিকায়, যাঁরা বিজেপির ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে গত দুই নির্বাচনে। হিন্দুধর্মাবলম্বী বাদ পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শিডিউল কাস্ট বা তফসিলি সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিধানসভার একজন শিডিউল কাস্ট এমএলএ সপরিবারে এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির নেতাদের বিরুদ্ধে সামাজিক পরিসরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আসামে, বিশেষ করে বরাক উপত্যকায় বিজেপির উত্থানে হিন্দু বাঙালিরা এত দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এলেও এনআরসির চূড়ান্ত তালিকাকে তারা প্রশাসনিক বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে। কংগ্রেস শাসনামলে মন্ত্রিসভায় হিন্দু বাঙালির সংখ্যা থাকত তিন থেকে চারজন। বিজেপির ভোটব্যাংক হওয়ার পর সেই হিস্যাও একজনে ঠেকেছে। এ রকম দুঃখগুলো হঠাৎ বেশি বেশি আলোচনায় আসছে শিলচরে।

মুসলমানরা আগেই এনআরসি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এবং তাঁরা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরও চূড়ান্ত তালিকায় তাঁদের কয়েক লাখ মানুষকে বাদ দেওয়া হয়েছে শুধু অসমিয়াদের খুশি রাখার জন্য। এ রকম সংখ্যালঘু বাদ পড়া ব্যক্তিরা সামাজিক পরিসরে এনআরসিবহির্ভূত বলে দৈনন্দিন রুটিরুজির সংগ্রামে অধিক বিপন্ন হয়ে পড়বেন বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। গুয়াহাটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রমিকদের মধ্যে ভীতির মনোভাব আগের চেয়েও বেড়েছে।

নয়ছয়ে ভরপুর তালিকা
একবার ‘খসড়া এনআরসি’ বিরুদ্ধে আপিল করার কাজে এসব মানুষের অনেকেই আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এখন ‘চূড়ান্ত এনআরসি’র বিরুদ্ধে আবেদন করতে গিয়ে বাদ পড়া ব্যক্তিরা আরেকবার ধারকর্জ করবেন।

মানবাধিকারকর্মীরা শত শত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, যেখানে মা-বাবাকে নাগরিক ঘোষণা করে তাঁদের কিশোর-কিশোরী সন্তানদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কোনো কারণ না দর্শিয়েই। বাদ পড়া ১৯ লাখের মধ্যে বিরাটসংখ্যকই বৃদ্ধাকে পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের বিয়ে হয়েছিল ‘বাবার বাড়ি’ থেকে বহু দূরে এবং মা-বাবার পরিচয়সূত্রের পক্ষে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করে পেশ করতে পারেননি তাঁরা। পশ্চিম বাংলার প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যে এ রকম ব্যাপক নজির তুলে ধরেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্য থেকে যেসব নারীর আসামে বিয়ে হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়ে বাপের বাড়ি ফিরতে চাইছেন এখন। স্মরণাতীতকাল থেকে কোচবিহারের অনেকের বিয়ে হচ্ছে পার্শ্ববর্তী আসামের ধুবড়িতে। আসাম-পশ্চিম বাংলা সীমান্তে অন্যত্রও এ রকম বিয়ের নজির বিপুল। এরূপ অনেক পরিবারেই কেউ কেউ নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন, কেউ কেউ পাননি। ধারণা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত এনআরসিতে বাদ পড়া এ রকম বহু মানুষ প্রাথমিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তর হতে পারেন।

আত্মঘাতী রাজনীতি
সামগ্রিক অবস্থায় আসামের পাশাপাশি নয়াদিল্লিতে নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পারছেন, এমন এক কার্যক্রম তাঁরা শুরু করেছিলেন, যার কোনো যৌক্তিক (এবং রাজনৈতিকভাবে লাভজনক!) উপসংহার দেওয়া যাচ্ছে না। চূড়ান্ত এনআরসির পরও আসামে বিদেশি-প্রশ্ন তীব্রভাবে থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি মানবাধিকার বিপন্নতার অদৃষ্টপূর্ব এক অবস্থা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। পুরো ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের ভয়াবহ এক ব্যর্থতা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। আসামে অসমিয়া-বাঙালি-ট্রাইবালনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের ওপর নিজ নিজ পরিসরে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। আপাতত শান্ত হলেও যেকোনো সময় এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে পারে। গুয়াহাটিতে রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এও বলছেন, আসামে সামাজিক বিবাদের ব্যাপকতা কমিয়ে আনার পরিবর্তে এনআরসি আরও বাড়াল, শিগগির যার বিধ্বংসী রূপ টের পাওয়া যাবে। কেউ কারও কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না এ মুহূর্তে। আসামে প্রধান রাজনীতিবিদেরা সবাই জনগণের কাছে অনেকখানি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছেন।

আন্তর্জাতিক জবাবদিহি
এ ঘটনায় রাজনীতিবিদদের বিদেশেও বিপজ্জনক এক জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে বলে অনুমিত হচ্ছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি ইতিমধ্যে গতকাল রোববার জেনেভা থেকে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভারতকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, আসামে একজন ব্যক্তিও রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়বেন না এবং তাঁদের পুরো প্রক্রিয়ায় তথ্যগত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আসামে এনআরসি থেকে বাদ পড়া কেউই এখনো নিশ্চিত নন, ঠিক কী কী কারণে তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এনআরসি কার্যক্রমের পুরোটা একান্তই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণহীন এক আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়েছে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন আদালতের কঠোর নির্দেশনাগুলোকে।

এনআরসি নিয়ে কেন্দ্রীয় ভারত এবং আসামের নীতিনির্ধারকেরা ধারণাগত সংকটে পড়েছেন। এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান ও বক্তব্যেও স্ববিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। আইনগতভাবে চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ পড়ার মানে দাঁড়ায় জাতীয়তাহীন হয়ে পড়া—রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়া। বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃবৃন্দ গত ছয় থেকে সাত বছরে বহুদিন বহুবার বহু জনসভায় বলেছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের ‘বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে’। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানেই ‘রাষ্ট্রবিহীন’ বা ‘বিদেশি’ হয়ে পড়া নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোদ ঢাকায় এসে বলে গেছেন, এনআরসি ভারতের নিজস্ব বিষয়। যদিও হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো আসামের কয়েকজন রাজনীতিবিদ নিজেদের এত দিনকার বক্তব্যের নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে যাওয়ায় এখনো বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মিডিয়া মাতিয়ে রাখতে চাইছেন। কিন্তু আসাম থেকে কাউকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়টি আপাতত নয়াদিল্লিতে শোনা যাচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে এবং এখনই কাউকে ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হবে না। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃবৃন্দ স্বীকার করছেন, এনআরসি একটা ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্প; কেবল কারিগরি দিক থেকে না, ধারণাগত দিক থেকেও।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডির গতকালের বিবৃতির পরই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানেই ‘রাষ্ট্রবিহীন’ হয়ে পড়া নয়। ‘বিদেশি’ হিসেবে শনাক্ত হওয়াও নয়। বরং এ রকম বাসিন্দারা সব ধরনের আইনগত সুবিধা ভোগ করতে থাকবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতি আইনগতভাবে সঠিক হলেও সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এত দিনকার রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতির একেবারেই বিপরীত। অবৈধ অভিবাসীদের ওই নেতৃবৃন্দ এত দিন ‘তেলাপোকা’র সঙ্গে তুলনা করে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের আসামেই যদি সব ধরনের আইনগত সুবিধা দিয়ে নির্বিঘ্নে থাকতে দেওয়া হয়, তাহলে এত রক্তপাতের মাধ্যমে এত ব্যয়বহুল প্রকল্প কেন নেওয়া হলো, সেটাও বিরাট প্রশ্ন আকারে হাজির হয়েছে আসামের রাজধানীতে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক