রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনীতির দ্বিতীয় পথ

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকট। এদিকে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) নিয়ে বাড়তে থাকছে উৎকণ্ঠা। এত সব জটিলতার গিঁট খোলার দিশা দিতে পারে ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি বা কূটনীতির দ্বিতীয় পথ। অন্য ভাষায় একে বলা যায় বেসরকারি কূটনীতি। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের বিভিন্ন শরিক এতে জড়িত হবে। সেখানে থাকতে পারেন শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নেওয়া ব্যক্তিবর্গ, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, অবসরে থাকা সামরিক-বেসামরিক আমলা কূটনীতিক প্রমুখ। রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিক সমাজের নিজ নিজ চেনাজানা ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে সংলাপ শুরু করতে পারেন তাঁরা।

প্রতিবেশীর সঙ্গে সংকট, মতের অমিল, দ্বন্দ্ব, মন-কষাকষি ইত্যাদি নিরসনের প্রধান পথ হচ্ছে আলাপ-আলোচনা। এসব আলোচনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আছে, দেশে দেশে আমাদের দূতাবাস আর রাষ্ট্রদূতেরা আছেন। এঁদের তাবৎ কার্যক্রমের প্রায় সবটাই আনুষ্ঠানিক নিয়মনীতি মেনে কেতাদুরস্ত পথে চলে। কিছু চলে খোলাখুলি, কিছু চলে পর্দার আড়ালে—‘নীরব দূতিয়ালি’ বা সাইলেন্ট ডিপ্লোমেসির মোড়কে। এসবই কেতাবি কূটনীতির অংশ।

কেতাবি কূটনীতির বাইরে আরেকটি দূতিয়ালির তরিকা হচ্ছে দুটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধারাবাহিক মতবিনিময় বা ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি’ (কূটনীতির দ্বিতীয় পথ)। মূল কূটনীতির শুধু পরিপূরক নয়, বরং পথপ্রদর্শক হতে পারে এই কৌশল। কেননা, সমস্যার সমাধান কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই হয় বা হবে, তা ভাবা ঠিক হবে না। সে জন্য নিকট ও দূর প্রতিবেশী থেকে শুরু করে চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত, আশিয়ান জোটভুক্ত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইনের নাগরিক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের। ইইউয়ের ফ্রান্স, জার্মানি এবং দলছুট ব্রিটেন, ন্যাটো সদস্য তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাগরিক সমাজকেও যোগাযোগের আওতায় আনা প্রয়োজন। এমনকি এই নাগরিক আলোচনায় খোদ মিয়ানমার এবং এই অঞ্চলের বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকেও যুক্ত করা প্রয়োজন।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারকে আমাদের পক্ষে এগিয়ে আসার জন্য বেসরকারি যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। স্বীকৃতি না পাওয়া একটা দেশের পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্র আর আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সে সময় আমাদের বক্তব্য পৌঁছানোয় সেটাই ছিল মূল পথ। খেলোয়াড়, লেখক, গায়ক, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, পদত্যাগী কূটনৈতিক কর্মী, শিক্ষক, প্রবাসী ছাত্র, গৃহিণী—কে ছিল না সেই দলে? কেউ নিজ দায়িত্বে, কেউ জোট বেঁধে দেশের একেকজন প্রতিনিধির বা অ্যাম্বাসেডর দায়িত্ব পালান করেছেন। কেউ লিখে রাখলে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ছাত্রদের জন্য নিঃসন্দেহে সেসব জ্ঞানের এক হীরকখণ্ড হতে পারত।

স্বাধীনতার পর আমরা কূটনীতির এই প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় ধারাটা ধরে রাখতে পারতাম। সেটা হয়নি। একেবারেই যে হয়নি, তা বলা ঠিক হবে না। ফারাক্কা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে রাজি করানোর জন্য আমাদের বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের ঘরোয়া আলাপ-আলোচনার কথা আমাদের সবার জানা। এসবই হয়েছে খণ্ডিতভাবে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সরকারি সহায়তায় ধারাবাহিকভাবে এটা চালু থাকা দরকার।

একাত্তরের অনেক পরে, ১৯৮৬ সালে (১৯৮৭ সালে প্রকাশিত) জন ম্যাকডোনাল্ড আর ডায়ানে বেন্দাহম্যান সম্পাদিত হইচই ফেলে দেওয়া বই ‘কনফ্লিকট রেজ্যুলেশন: ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি’-তে ট্র্যাক টুর প্রয়োজনীয়তা নজরে আনেন। তাঁরা বলছেন, সরকারি বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের দক্ষতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা হালনাগাদ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ইতিহাস, সমাজ, কৃষ্টি এবং বর্তমান মনঃসামাজিক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে জানার কোনো বিকল্প নেই। সরকার বরং ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসিকে উৎসাহিত করলে সেটা অনেক সহজ হয়। জানা আর জানানোর জানালাগুলো খুলে যায় আপনা-আপনি।

কী আলোচনা হবে নাগরিকদের মধ্যে
ওপরে বলা তালিকার দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, এদের মধ্যে দুই-তিন ধরনের দেশ আছে, যাদের কেউ কেউ পরিস্থিতির শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে। আবার কেউ ছুটে এসেছে সাহায্য নিয়ে, দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পাশে। কেউ ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়েছে বা ভাবছে একটা বলছে আরেকটা বা ক্ষণে ক্ষণে মত বদলাচ্ছে। আলোচনার ধারা, ঢং আর বিষয়বস্তু হবে কথিত দেশগুলোর অবস্থানের আলোকে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের লক্ষ্য হবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানের পক্ষে ওসব দেশে একটা জোরালো জনমত গড়ে তোলা। জনমত গড়ে তোলার নানা তরিকা আছে। চিঠি লেখা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে ঘরোয়া সভা, সেমিনার, মিটিং, সাক্ষাৎকার দেখা-সাক্ষাৎ করার মতো কর্মসূচি এ কাজের অংশ হতে পারে। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যানসহ রাশিয়া থেকে পড়াশোনা করে এসে এখন দেশের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখা মেধাবী মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। (রাশিয়ার সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠনের বর্তমান সদস্যসংখ্যা এ রকম)। এঁরা বাংলাদেশ নাগরিক সমাজের পক্ষে রাশিয়ার নাগরিক সমাজের কাছে সহজেই পৌঁছাতে পারেন। একইভাবে ভারত, জাপান, চীনসহ নানা দেশের নাগরিকদের কাছে আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরতে পারি।

দেশের ভেতরেও রোহিঙ্গা বা এনআরসি ইস্যুতে নাগরিক সমাজের মধ্যে সিরিয়াস আলোচনার কোনো মঞ্চ গড়ে ওঠেনি, যেখান থেকে নিয়মিত আলোচনা/মতামতের আদান-প্রদান/তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকেরা পরিস্থিতি সমাধানের নানা ইঙ্গিত বা দিশা পেতে পারেন। দেশে নানা পেশাজীবী ও বিদ্যাচর্চামূলক সংগঠন থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাদের ধারাবাহিক চর্চার আলামত কমই চোখে পড়ে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে এক গোলটেবিলে বসেছিল এ বিষয়ে আলোচনার জন্য। ‘বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী: সমস্যা ও প্রভাব’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের কাছে আরও জোরালোভাবে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মিয়ানমারের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আদালতে তুলে যেন অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। মানতে হবে, এসবই অতি জরুরি এবং অবশ্যকরণীয়। এ ধরনের দক্ষ ও কৃতী ব্যক্তিদের সংগঠন বিশ্বজনমত, বিশেষ করে তাঁদের উল্লেখ করা চারটি দেশের (চীন, জাপান, রাশিয়া, ভারত) নাগরিক সমাজের মাধ্যমে সেসব দেশের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা কিন্তু রাখতেই পারেন। এটাও তাঁদের বিবেচনায় আসুক, সে প্রত্যাশা তো থাকবেই।

তবে এসবের আগে প্রয়োজন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে কফি আনান আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সমাধান সূত্রের আলোকে একটা জাতীয় কর্মকৌশল বা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা। এই কৌশলপত্র হবে পরিবর্তনযোগ্য একটি দলিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও বাস্তবতার আলোকে সেটা পরিবর্তিত হবে। এটা হতে পারে দেশে-বিদেশে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরির মূল ভিত্তি।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, গবেষক
[email protected]