আসামের নাগরিকপঞ্জি

আসামের নাগরিকপঞ্জি ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে কতটা বাস্তবতা রয়েছে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। যেখানে নাগরিকপঞ্জির লক্ষ্য হলো বিদেশি বা কার্যত ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করা, সেখানে এতটা নিরুদ্বিগ্ন থাকার সুযোগ আছে কি? এ কে আব্দুল মোমেন তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। 

কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটু গভীরে গেলে অনুধাবন করতেন যে আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে শুধু দেশটির কূটনৈতিক পেশা থেকে আসা পররাষ্ট্রমন্ত্রীই কথা বলেননি। সেখানকার প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হরহামেশাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করে যাচ্ছেন। তাঁরা যে ‘বিদেশি’ তাড়াতে চাইছেন এবং কোন দেশকে ইঙ্গিত করছেন, তা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের নামও বলেছেন। 

আসামে নাগরিকপঞ্জি তৈরির ঘটনাটি গোলমেলে। গেল শতকের আশির দশকে অসম ছাত্র পরিষদের দাবির মুখে রাজীব গান্ধীর সরকার যে চুক্তি করে, তাতে নাগরিকপঞ্জির কথা বলা হয়েছিল। সে সময়ে এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ‘বাঙালি।’ এখন আরও সুনির্দিষ্ট হয়েছে ‘বাঙালি মুসলমান’। প্রথমে যে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ তালিকার বাইরে ছিল। সর্বশেষ নাগরিকপঞ্জিতে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ। বর্তমান তালিকাও যে যথাযথ নয়, তা পরিষ্কার। কেননা, কারগিল যুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতের সাবেক সেনাসদস্য, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, বিধায়ক, এমনকি ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রপতির পরিবারের লোকজনও তালিকার বাইরে রয়ে গেছেন।

তালিকার বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। সেখানেও প্রতিকার না পেলে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে পারবেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নাগরিক তালিকায় যাঁদের নাম ওঠেনি, তাঁদের একজনকেও আটক করা হবে না। শেষ আইনি প্রক্রিয়া পর্যন্ত তাঁরা সব ধরনের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগ করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত যাঁরা নাগরিকত্ব হারাবেন, তাঁদের কী হবে?

কোনো দেশের নাগরিক যদি অন্য দেশে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া প্রবেশ করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন আছে। বিশ্বের যেকোনো দেশের সরকার সেটি প্রয়োগ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের কিছু করার নেই। কিন্তু প্রতিবেশী কোনো দেশকে অভিযুক্তের তালিকায় রেখে নিজ দেশে নাগরিকপঞ্জি বানানো মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী ভারতের একটি রাজ্যে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়লে, এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত।

দুই বছর আগে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। মিয়ানমার এই জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করে অত্যাচার–নির্যাতন চালিয়ে দেশছাড়া করেছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ দুই বন্ধুদেশ ভারত ও চীনকে তেমনভাবে পাশে পায়নি। এটা স্পষ্টতই বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এই বাস্তবতায় ভারতের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে নিরুদ্বেগ থাকার সুযোগ নেই। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের তরফে সক্রিয় ও কার্যকর কূটনীতি কাম্য। 

অন্যদিকে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের উচিত তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্তে হত্যা কিংবা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।