পরিস্থিতি ঘোলাটে, বাংলাদেশের অবস্থান অস্পষ্ট

নিজের নাগরিকদের ফেরত নেওয়া মিয়ানমারের দায়িত্ব
নিজের নাগরিকদের ফেরত নেওয়া মিয়ানমারের দায়িত্ব

অনিবার্য কারণে অনেক দেশের আকাশেই দুর্যোগের কালো মেঘ দেখা দিতে পারে। দুঃসময় ঘনিয়ে আসে। প্রাকৃতিক হোক, মানবসৃষ্ট হোক, যেকোনো দুর্যোগে জাতির পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ঐক্য—ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঐক্য। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তা বাধা নয়। মুষ্টিমেয় দালাল ছাড়া একাত্তরে জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়। বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছিল, বহির্বিশ্বের সহানুভূতি ছিল, কিন্তু জনগণের ঐক্য ও ত্যাগ ছাড়া কোনো অর্জন সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতা রক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু সরকারি দলের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের বাইরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা দরকার। তার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে ক্ষমতাসীনদের ভূমিকাই প্রধান। সরকারের বাইরে যারা, তাদের ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। 

আজ বাংলাদেশের মানুষ অতি শান্তিতে থাকলেও তারা কিছুমাত্র শঙ্কায় নেই, তা বলা যায় না। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। টক শোর দ্বিদলীয় বাঁধাধরা বাহাসে কে কী বললেন, না বললেন তা শ্রোতাদের চিন্তা–চেতনায় কোনোই প্রভাব ফেলে না। দেশের সচেতন নাগরিকদের মাথায় অ্যান্টেনা রয়েছে। তাতে অনেক কিছুই ধরা পড়ে। জনগণ এমন এক জিনিস, নেতাদের কথায় তাদের চিড়া ভেজে না। তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি যেমনই হোক, তাদের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা রয়েছে। 

যখন বিপদ ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘনিয়ে আসে, তখন স্রেফ বক্তৃতাবাজি করে শেষরক্ষা হয় না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দেরি নেই। দারিদ্র্য দূরসহ বহু ক্ষেত্রে বিপুল অর্জন হয়েছে। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ভালো আছে, সে দাবি কেউ করবে না। অবশ্য সৌভাগ্যবানের সংখ্যাও বিপুল। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের মতো আজ আর তাঁদের গ্রামের পৈতৃক ভিটেমাটির প্রয়োজন নেই। সেসব থাকল কি থাকল না, তাতে তাঁদের কিছু যায়–আসে না। বছরে সেখানে যতবার যান, তার চেয়ে তাঁরা অনেকবার বেশি যান সেকেন্ড হোম–থার্ড হোমে। ঢাকার ফ্ল্যাট বা বাড়ি আপাতত দরকার। তাঁদের আসল ও স্থায়ী বাসস্থান হেথা নয় হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। শেষ জীবনটা সেখানেই চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সুখ–শান্তিতে মর্যাদাহীনভাবে কাটবে। সেখানকারই কোনো গোরস্থানেই হবে শেষ ঠাঁই। দেশের ব্যাংকের চেয়ে বিদেশের ব্যাংকেই তাঁদের জমার পরিমাণ বেশি। সুতরাং দেশের কোনো ক্ষতি হলে তাঁদের কিছু আসে–যায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের দেশের মাটি ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সে জন্য উদ্বেগটা তাদেরই, দেশের মঙ্গল-অমঙ্গল তাদের বুকে বাজে। 

ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী নেতাদের দুর্বার আন্দোলনের ফলে ভারত-পাকিস্তান ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা লাভ না করলে মিয়ানমারের স্বাধীনতা অর্জন ছিল সুদূরপরাহত। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে সে দেশের মানুষ গণতন্ত্রের মুখ দেখেনি। একটি নষ্ট রাষ্ট্র হিসেবে তার পরিচিতি। নিজের দেশের মানুষের ওপর সেখানকার সামরিক জান্তাগুলো পাশবিক জুলুম চালাচ্ছে ৭০ বছর ধরে। কিন্তু মুক্ত বাজারি পৃথিবী আজ এমন যে মিয়ানমারের বন্ধুর সংখ্যা ভাগ্যবিড়ম্বিত বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। নজিরবিহীন অমার্জনীয় অপরাধ করা সত্ত্বেও তার সঙ্গে চুটিয়ে বাণিজ্য করছে বড় বড় দেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে আসছে সংকুচিত। 

অর্থের পেছনে পাগলের মতো ছুটছে সারা পৃথিবী। দুনিয়া থেকে সত্য, নৈতিকতা, মানবতাবোধ যেন উঠে যাচ্ছে। ওসব এখন স্রেফ নীতিদর্শনের কিছু শব্দ। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের বর্বরতাকে যেসব দেশ গণহত্যা বলেছে, সেসব দেশের ব্যবসায়ীরাও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যবসা করছেন। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা যেসব দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে বলে তথ্য পেয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, রাশিয়া, ভারত, দুই কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইসরায়েল, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি। এর মধ্যে পশ্চিমের অনেক দেশ মানবাধিকারের প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ। প্রতিবছর তারা বাংলাদেশের মানবাধিকারের প্রশ্নে সালিস বসায়। সেই কাঠগড়ায় গিয়ে আমাদের সরকারের কর্তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে ব্যর্থ হন। 

ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিষয় ছাড়া গুরুতর রাজনৈতিক বিষয়ে যখন কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আর একটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন সেই চুক্তির খসড়া পার্লামেন্টের সদস্যরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেন। তাতে কোনো স্বার্থহানিকর কিছু রয়েছে কি না, কোনো ভাষাগত দুর্বলতা রয়েছে কি না। বিরোধী দলের সাংসদদের মতামতও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তার ফলে যদি কখনো সেই চুক্তি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়, তার দায় শুধু সরকারি দলের ওপর বর্তায় না। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসিখুশির মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা হয়নি। আর আলোচনা হলেও কোনো লাভ হতো না, কারণ সেখানে ভিন্নমত দেওয়ার মতো কোনো বিরোধী দল ছিল না। 

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা যাদের উদ্দেশ্য, তারা যে এই বিতাড়িতদের ফেরত নেবে, সে প্রত্যাশা আমাদের সরকারের কিছু নেতা ছাড়া কেউ করেননি। তারপরও যখন সরকার থেকে বলা হলো ২২ আগস্ট সাড়ে তিন হাজার শরণার্থী ফেরত যাবে, মানুষ কিছুটা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া তারা যেতে রাজি হয়নি। শুধু তা–ই নয়, দুই দিন পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা কুতুপালং-মধুরছড়া এলাকায় সমাবেশ করে। পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। 

দু–এক হাজার রোহিঙ্গা গেলে কী লাভ হতো আর না যাওয়ায় কী ক্ষতি হয়েছে, তা বিচার করে দেখার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তারা নানা রকম বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণের বিরক্তির উদ্রেক করে, এমন কথাবার্তা উচ্চাসনের ব্যক্তিদের না বলা ভালো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক দুর্বলতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো অন্যায়। পিণ্ডিটি যদি উদোর হয়, তা হলে তা তাকেই বহন করতে হবে, বুধোর ঘাড়ে নয়। নির্যাতিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছিল। এখন আবোলতাবোল বক্তব্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অপ্রশংসিত হলে বাংলাদেশের ডাবল ক্ষতি। 

নিজের নাগরিকদের ফেরত নেওয়া মিয়ানমারের দায়িত্ব। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী। তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে থাকতে চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শান্তির নীতি ও সদিচ্ছাকে যদি সে দেশ সম্মান না দেখায়, তার দায় তাদের। মিয়ানমার যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, সেখানকার সামরিক জান্তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ বৌদ্ধ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে একটা বিরোধ জিইয়ে রাখতে চাইবে তাদের কায়েমি স্বার্থ থেকে। এবার কোনোরকমে কয়েক শ বা হাজারখানেক রোহিঙ্গা ফেরত গেলে জাতিসংঘের ফোরামে মিয়ানমার প্রমাণ করতে পারত যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে ইচ্ছুক এবং প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। 

যতই দিন যাচ্ছে, ততই পরিবেশ ঘোলাটে হচ্ছে। জাতীয় ঐক্য ও দক্ষ কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো আপাতত নীরব দর্শক, এরপর তারা দুই দেশ থেকেই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে। আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ইরান ও ভেনেজুয়েলায় যত শক্ত অবস্থানে, মিয়ানমারে ততটা নয়। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের নেতাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এর মধ্যে ভারতের আসাম রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ায় জনগণের মধ্যে আরেক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মধ্যেই নিহিত সরকারের সাফল্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক