মজা পুকুর কাটার মজার প্রকল্প

খাল কাটলেই কুমির আসে না। যদি আসত তাহলে চাচা মামা খালা খালুরা খালি খাল কাটত, খরচাপাতি করে খামারে কুমিরের চাষ করত না। এখন আর খাল কাটা কর্মসূচি ‘জিয়া নেহি রে’। পুকুর কেটে পুকুরচুরির যুগও অস্ত গেছে। এখন পুকুর না কেটেই পুকুরচুরির চল চলছে। 

এমনিতে ২০-২৫ জন মাটি কাটার শ্রমিক কাজে লাগিয়ে দিলেই দশ–পনেরো দিনের মধ্যে বড়সড় পুকুর কেটে ফেলা যায়। আর মজে যাওয়া পুকুর কাটতে প্রথমে পানি সেচে ফেলতে হয়। তারপর মজা পুকুর মজা করে কাটতে হয়। এর জন্য জাদুমন্তর লাগে না। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শও দরকার হয় না। এটি হলো, ‘এসো নিজে করি’ কায়দায় পুকুর খননের উপায়। 

কিন্তু হায় ‘কত অজানা রে!’ 

সম্প্রতি আমরা জানলাম, মজা পুকুর কাটা ‘যাই–তাই’ ব্যাপার না। এর মধ্যে ম্যালা তাইরে–নাইরে আছে। আমরা জানলাম, কাটা পুকুর ফের কাটা নাবালেগ শিশুকে পুনর্বার খতনা করার চেয়েও স্পর্শকাতর, জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। লোকাল ‘হাজামি জ্ঞান’ দিয়ে এই কাজ সম্ভব না। এই জ্ঞান আনতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড অথবা নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার দরকার হয়। 

পত্রিকার খবরে বেরিয়েছে, সরকার ঠিক করেছে বরেন্দ্র অঞ্চলে বহু আগে যে পুকুরগুলো লোকজন সেচের কাজে ব্যবহার করতেন, সেগুলো আবার খনন করা হবে। ফের খননে বুড়ো হাবড়া পুকুরের যৌবন ফিরে আসবে। নতুন পানি থইথই করবে। সেই পানি ফসলের মাঠে যাবে। সেই সেচে বাম্পার ফলন হবে। ফসলের মাঠ রাজনৈতিক মাঠের মতো ‘গরম’ হয়ে উঠবে।

এই ‘এক পুকুর আশা’ নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের নাম ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’। প্রকল্পটির আওতায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও বগুড়ায় মোট ৭১৫টি
পুকুর ও ১০টি দিঘি আবার খনন করা হবে। প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সব মিলিয়ে খরচা পড়বে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তার মানে, একেকটি মজা পুকুর খুঁড়তে গড়ে খরচা হবে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ১০৩ টাকা। মানে, পৌনে
আঠারো লাখ টাকা খরচ করে আমরা একেকটি পুকুর মেরামত করতে যাচ্ছি। 

প্রকল্পের নীতিনির্ধারকেরা ঠিক করেছেন, মজা পুকুর কাটার মতো একটি জটিল, সৃজনশীল ও মেধাদীপ্ত কাজ আনাড়ি লোক দিয়ে হবে না। দক্ষ লোক লাগবে। সেই দক্ষতা অর্জন করার জন্য এই প্রকল্পের ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন। জ্ঞান লাভের জন্য তাঁরা ‘সুদূর চীন দেশে’ যাবেন না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড অথবা নেদারল্যান্ডস—এই তিন দেশের যেকোনো একটিতে যাবেন। এ জন্য তাঁদের রাহা-খরচ থেকে খোরাকি খরচা বাবদ পড়বে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিদেশ থেকে ঝুড়িভর্তি পুকুর কাটা জ্ঞান নিয়ে ফিরে অফিসে বসে থাকলেই তো আর হলো না। দেশে ফেরার পর এসব কর্মকর্তা সরাসরি মাঠপর্যায়ে গিয়ে পুকুরের কাজে অথবা কাজের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ঝাঁপাঝাঁপির মধ্যে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তার জন্য বাড়ি ভাড়া করা হবে। ১০ জন কর্মকর্তা ও ৮ জন কর্মচারীর বাড়িভাড়া হিসেবে মাত্র ১ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। এই মাইক্রোসকপিক অ্যামাউন্টের টাকা খরচ করার জন্য যে ধরনের বাড়ি ভাড়া নিতে হবে, মফস্বল শহরে তা পাওয়া যাবে কি না, সেটিই এখন বিরাট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে মজা পুকুর আছে কি না এবং পুকুর খোঁড়াখুঁড়ি করার জন্য সেখানকার কোন কোন বিজ্ঞানী কী কী সূত্র আবিষ্কার করেছেন, তা দেখার জন্য গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। গুগল এ বিষয়ে তেমন কিছু জানে না বলে সামান্য লজ্জা পেয়েছে। তবে সে অব্যক্ত অভিব্যক্তিতে যা বলল, এককথায় তার মর্মার্থ হলো—পুকুরচুরি। 

পুকুরচুরি দেশে নতুন কিছু না। হামেশাই এই জিনিস চুরি হচ্ছে। তার জন্যই দেশের ‘পুকুরেতে পানি নাই পাতা তবু ভাসে’ অবস্থা। তবে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পুকুরে পানি তো থাকবেই, সেই পানিতে যাতে পর্যাপ্তসংখ্যক পাতা ভাসে, তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পে প্রতিটি পুকুরের পাড়ে গাছ লাগানো হবে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ কোটি টাকা। 

এবার চোখ বুজে ভাবুন: পুকুরভর্তি পানি। পাড়ে সারি সারি গাছ। গাছভরা ছায়া। সেই ছায়ার নিচে আপনি। ঝিরি ঝিরি বাতাস। বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। পাতার ফাঁকে পাখি ক্যাচ ক্যাচ করছে। পুকুরের পানিতে পাতার ছায়া দুলছে। এই ‘ছায়াডাকা পাখিঢাকা’ (‘ছায়াঢাকা পাখিডাকা’ নয়) দৃশ্যকল্প মনের মধ্যে এলে যেকোনো আবেগপ্রবণ মানুষের গা–গতরের সব জায়গার লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। 

অথচ এই অতিপ্রয়োজনীয় ছায়াবতী পরিবেশ তৈরির খরচকে কিছু লোক ‘বাজে খরচ’ বলছে। অন্যের ভালো দেখতে না পারা কিছু লোক বলছে, নতুন কোনো প্রকল্প হলেই তার সঙ্গে বিদেশ সফর রাখা একটা স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নাকি জনগণের ওপর করের চাপ বাড়ে। এসব দুর্মুখ প্রশ্ন তুলে যাচ্ছে, পুকুর কেটে কী হবে, যদি তাতে পানি না থাকে? রাস্তা বানিয়ে কী লাভ তার ওপর দিয়ে যদি গাড়ি চলতে না পারে? কী হবে শিক্ষা মিশন চালিয়ে, যদি শিশুরা লিখতে-পড়তে না শেখে? কী হবে স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে, যদি তা আরোগ্য না আনে? তারা বলছে, প্রকল্প মানুষের জন্য কী করতে পারল, তা ভুলে গিয়ে প্রকল্প বানানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন কর্মকর্তারা। 

এসব রাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তাকে পাত্তা দিলে দেশ নির্ঘাত পুকুরে পড়বে। কর্তাদের এসব কথায় কান বা চোখ কোনোটাই দেওয়া ঠিক হবে না। এসব ফালতু কথা বলা আঁতকা বুদ্ধিজীবীদের ‘রাবিশ-বোগাস’ জাতীয় একটা কিছু বলে থামিয়ে দেওয়া দরকার। নয়তো কবে হয়তো তারা যেকোনো প্রশ্নপত্রে ঢুকিয়ে দেবে—

প্রশ্ন) এককথায় প্রকাশ করো: ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’ প্রকল্প। 

উত্তর): ‘পুকুরচুরি’। 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক