বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক: অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা অগ্রহণযোগ্য

সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে গত ২৫ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রণীত ও উপস্থাপিত এই নীতিমালাটি শিক্ষামন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন; তবে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় রত বাংলাদেশি শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করে এই নীতিমালা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি অনেক দিন ধরে কাজ করছে। ইউজিসির ওয়েবসাইটে ২২.০১.২০১৮ তারিখে প্রকাশিত অভিন্ন নীতিমালা, যেটি ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখের ইউজিসির সভায় চূড়ান্ত করা হয়, সেখানে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ প্রণয়নের পর শিক্ষকদের বেতনকাঠামো নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে ইউজিসির মাননীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কমিশনের সম্মানিত সদস্যগণের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ প্রশাসনের কয়েকজন সিনিয়র সচিবের কয়েক দফা আলোচনাকালে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়নসংক্রান্ত একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি প্রাধান্য পায়’। এরই ধারাবাহিকতায় খসড়া নীতিমালাটি শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে চূড়ান্ত করার বিষয়টি সাম্প্রতিকতম ঘটনা। উল্লেখ্য, চূড়ান্ত নীতিমালাটি যেটি শিক্ষামন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে, সেটি এই লেখা তৈরি করা পর্যন্ত ইউজিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে চূড়ান্ত নীতিমালায় কী রয়েছে বা খসড়া নীতিমালার সঙ্গে চূড়ান্ত নীতিমালার কী কী পার্থক্য রয়েছে, তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

শিক্ষকদের অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতির এই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে একাধিক কারণে আমরা শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। 

প্রথমত, যে কারণ দেখিয়ে অভিন্ন নীতিমালাটি তৈরির কথা বলা হয়েছে, সেটির সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়টি জোর করে সম্পৃক্ত করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। এ ক্ষেত্রে সচিবদের কয়েক দফা আলোচনার বিষয়টি লক্ষণীয়। 

দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও চর্চার সঙ্গে অভিন্ন নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়টি একেবারেই বেমানান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান তৈরির জায়গায় স্বকীয়। প্রতিটির নিজস্বতা রয়েছে, রয়েছে স্বাতন্ত্র্যও। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অভিন্ন হওয়া সমীচীন নয়। 

তৃতীয়ত, ইউজিসির ওয়েবসাইটে যে নীতিমালাটি দেওয়া আছে, সেখানে এ–ও বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সমান নয় এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে একধরনের বৈষম্য বিরাজমান।’ খুবই সত্যি কথা! আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেভাবে জ্ঞানের চর্চা করা হয়, জ্ঞান তৈরি, বিতরণ ও সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে এই পার্থক্যটুকু থাকাই বরং সমীচীন। এটিকে বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না দেখে দেখতে হবে পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি এক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো আরেক দিক দিয়ে শক্তিশালী হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এভাবেই নিজের শক্তির দিকগুলো তুলে ধরে, সেটির চর্চা ও প্রকাশ করে। 

উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশ্বের অনেক সেরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে র‍্যাঙ্কিংয়ে শেষের দিকে অবস্থানকারী বিশ্ববিদ্যালয়ও। সেখানেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ‘সমান নয়’ এবং সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বৈষম্য রয়েছে। কিন্তু তাই বলে সবাইকে সমান করার কোনো নীতিমালা ওই সব দেশে গ্রহণ করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। 

চতুর্থত, বেতনকাঠামোর সঙ্গে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতিকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা উঁচুতে থাকলেও বাংলাদেশের সব পর্যায়েই শিক্ষকেরা অবহেলিত। প্রাসঙ্গিকভাবেই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে সমমর্যাদার একজন সচিবের সুবিধাদি তুলনা করে দেখা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কী পরিমাণ পিছিয়ে আছেন, তা সহজেই উপলব্ধি করা যাবে। মাধ্যমিক বা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের কথা আপাতত বাদই থাকল। যেখানে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে–স্কেলের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বেতনকাঠামো নিয়ে যদি কোনো সমস্যা থাকেই, তাহলে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল হতে পারত একটি চমৎকার সমাধান। শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত পথে না গিয়ে জোর করে কেন বেতনের সঙ্গে নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। 

পঞ্চমত, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের পথ সুগম করেছেন এবং তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের সূচনা হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেছিলেন উদার ও প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বায়ত্তশাসনের চেতনার সঙ্গে অভিন্ন নীতিমালা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। যে প্রক্রিয়ায় ও যে কারণে এই নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, তা থেকে আমাদের মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধু যে চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের পথ খুলে দিয়েছিলেন, তার ঠিক উল্টো পথে হাঁটার চেষ্টা করা হচ্ছে। 

খসড়া নীতিমালায় যেসব বিষয় রয়েছে, তার নানা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেমানান। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এসব নিয়মের অনেক কিছুই বর্তমানেও প্রচলিত। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসির ফল বিবেচনায় রাখা। মাধ্যমিকের ফল দিয়ে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই। পদোন্নতি কঠিন করার নামে কমানো হচ্ছে শিক্ষকদের সুযোগ–সুবিধাও। সব মিলিয়ে আমরা তাই এই নীতিমালা এবং নীতিমালা তৈরির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ভালোভাবে চলছে না এবং মানের ঘাটতি রয়েছে, সেসব বিষয় মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা নেই। কিন্তু এর সমাধানের দায়িত্ব দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিয়ম দিয়ে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে বরং শক্তিশালী করতে হবে অধিক পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের গুরুভার দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া যে বর্তমান যুগের উপযোগী নয়, এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই। কিন্তু নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে আধুনিকায়নের দায়িত্ব দিতে হবে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়কেই। রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধরন এক নয়। রাষ্ট্র যঁারা পরিচালনা করবেন, তঁাদের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো কাজ করতে দিলে প্রকারান্তরে রাষ্ট্রই শক্তিশালী হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের বহুল অংশগ্রহণ রয়েছে, কিন্তু শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সে তুলনায় কম। 

আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আহ্বান জানাব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, এমন নীতিমালা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকতে। আমরা বরং এ আহ্বান জানাই, ইউজিসিকে শুধু মঞ্জুরিসংক্রান্ত কাজে সীমাবদ্ধ না রেখে এর পরিসর বড় করে জাতীয় উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করতে। এই কমিশন দেশের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যকে সঙ্গে নিয়েই। 

লেখক: কামরুল হাসান মামুন, স্বাধীন সেন, কামাল চৌধুরী, প্রিয়াঙ্কা কুণ্ডু, জাকিয়া সুলতানা, নাসির আহমেদ, মাইদুল ইসলাম, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, রুশাদ ফরীদী, বখতিয়ার আহমেদ, মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, সামিনা লুৎফা, কাজী এস ফরিদ, কাজী অর্ক রহমান, মানস চৌধুরী, কাজী মামুন হায়দার, সায়েমা খাতুন, রায়হান রাইন, পারভীন জলি, সুবর্ণা মজুমদার, আবদুল মালেক, মোহাম্মদ মজিবর রহমান, ফাহমিদুল হক 

*লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক