পাটগ্রামে পাথর ভাঙা যন্ত্র

স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নষ্ট করে কতিপয় ব্যবসায়ীকে নিষ্ঠুর উপায়ে বাণিজ্য করার এবং অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে নাগরিক স্বাস্থ্যহানির পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। কিন্তু লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নে সবার সামনেই দিনের পর দিন এ ধরনের জনস্বাস্থ্যহানিকর কাজ চলছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, লালমনিরহাট-বুড়িমারী স্থলবন্দর মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক সড়কের পাঁচ কিলোমিটারে পাঁচ শতাধিক পাথর ভাঙার যন্ত্র বসিয়ে পাথর ভাঙা হচ্ছে। এগুলো হাটবাজার, জনবসতিপূর্ণ এলাকা এমনকি বিদ্যালয়ের আশপাশে বসানো হয়েছে। ৫ থেকে ২০ হাত পরপর এগুলো স্থাপন করা হয়েছে। এসব যন্ত্র থেকে বের হওয়া পাথরের গুঁড়া শরীরে ঢুকে পাথর ভাঙা শ্রমিকসহ স্থানীয় বাসিন্দারা শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

পাথর ভাঙার যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসা ধুলা নাক–মুখ দিয়ে শরীরে ঢুকে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, কাশি, ফুসফুসে প্রদাহ, যক্ষ্মা, সিলিকোসিসসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। পাথর ভাঙার যন্ত্রের কারণে বুড়িমারী ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যন্ত্রের বিকট শব্দে কাঁপছে চারপাশ। প্রতিটি যন্ত্রে ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তাঁরা বড় পাথর যন্ত্রের এক প্রান্তে ফেলছেন। যন্ত্রের আরেক প্রান্ত দিয়ে ওই পাথরের গুঁড়া বের হচ্ছে। পাথরের গুঁড়ার সঙ্গে ধুলা বেরিয়ে বাতাসে উড়ে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।

উচ্চ শব্দ এবং ধুলায় ইউনিয়নের ২৫ হাজার মানুষই ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে ৩ হাজার শিক্ষার্থী আছে। তবে চরম ঝুঁকিতে পাথর ভাঙার কাজে নিয়োজিত ১০ হাজার শ্রমিক। এসব শ্রমিকের পাশাপাশি পাথর পরিবহনের কাজে জড়িত প্রায় ৫ হাজার ট্রাকচালক ও তাঁদের সহকারীরা ঝুঁকিতে আছেন। গত ১৩ বছরে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ৬০ জন পাথর ভাঙা শ্রমিক মারা গেছেন। বর্তমানে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩০ জন। এর মধ্যে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

পরিবেশবিদ এবং চিকিৎসক সমাজ এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করার পরও যখন কাজ হয় না, তখন ধরে নিতে হয় এর পেছনে ক্ষমতাধর ব্যক্তির স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু অল্প কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের জানমালের ক্ষতি কোনো বিচারেই ন্যায্যতা পায় না।

আমাদের দেশে ব্যবসার যথেচ্ছ স্বাধীনতাকে মৌলিক স্বাধীনতা ভাবতেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই ব্যবসার মুনাফা তুলতে গিয়ে জনগণের কতটুকু ক্ষতি হলো তা বিবেচনায় আনার রেওয়াজ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এতে নাগরিকের শ্বাস গ্রহণের স্বাধীনতা নয়, বরং ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার স্বাধীনতাকেই কর্তৃপক্ষ প্রাধান্য দিচ্ছে।

কিন্তু সবাই চুপ থাকলে এই নৈরাজ্য চলতেই থাকবে। বুড়িমারীর এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে হলে নাগরিক সংগঠনগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। পুলিশকে তার কর্তব্য করতে হবে। সর্বোপরি জনস্বার্থের প্রশ্নে জনপ্রতিনিধিদের সর্বাংশে নিষ্ক্রিয় থাকার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।