কাশ্মীর ঘিরে ভূরাজনীতির খেলা

আফগান বংশোদ্ভূত কেউ নোবেল পুরস্কার পায়নি এখনো। ৭০ বছর বয়সী জালমে খলিলজাদ আগামী বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য শক্ত এক প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন। পুরস্কারটি পেলে মালালা ইউসুফজাইয়ের পর পশতুনদের মধ্যে তিনি হবেন দ্বিতীয়। তবে কোনো দিন পশতুন ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়নি তাঁকে। বহুকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন। ‘যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ’ এখন তিনি। আরও সরাসরি বললে, রিপাবলিকান শিবিরের এশিয়া নীতির অন্যতম স্থপতি।

অনেক দিন হলো কূটনীতিবিদ হিসেবে খলিলজাদ চেষ্টা করছেন যুক্তরাষ্ট্রকে আফগান যুদ্ধ থেকে বের করে আনতে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টা সফল হতে পারে। চলতি মাসেই তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শান্তিচুক্তি’ হবে বলে জোর আঁচ-অনুমান চলছে। সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে ভারত কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পরপর আফগানিস্তানে তালেবানদের আবার মেনে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেকের বিবেচনায় এটা যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের নাটকীয় অগ্রগতির ফল।

তালেবানদের ফিরে আসার সুযোগ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের জন্য বড় এক আঞ্চলিক উপহার। এটা ঘটেছে আফগান যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষ্কৃতি পেতে ইসলামাবাদের সহায়তার বিনিময়ে। সে যুদ্ধে ন্যাটো সৈনিকেরা প্রকৃতই ক্লান্ত। এমনকি মাঠে এখনো ২০ হাজার সৈনিক থাকার পরও। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রচারমাধ্যমেই তালেবান যোদ্ধাদের আর আগের মতো ‘টেররিস্ট’ বলা হচ্ছে না। যদিও ১৮ বছর আগে এদের নির্মূলের জন্যই ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’ (টেকসই স্বাধীনতার লক্ষ্যে অভিযান) শুরু হয়েছিল। সেখানে স্বাধীনতা ও শান্তি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। গত জুলাইয়েও অন্তত দেড় হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত বা আহত হয়েছে। এর মধ্যেই সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ রয়েছে, যদিও তা বাতিল হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন একটা সরকার গঠনের সম্ভাবনাই বেশি।

আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জেতেনি, প্রায় কিছুই অর্জন করতে পারেনি। দেশটির বিরাট এলাকা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। প্রদেশগুলোর রাজধানীর বাইরে ওয়াশিংটন-সমর্থিত সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে শান্তিচুক্তির আড়ালে খলিলজাদ অন্তত এটা ধামাচাপা দিতে চান—যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হারেওনি। কেবল এটুকুই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় দারুণ এক পণ্য হয়ে উঠতে পারে। আগামী বছরের নির্বাচনী যুদ্ধ সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কট্টর ডেমোক্র্যাটরা যখন সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, কর্মজীবীদের ন্যূনতম মজুরি ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার, ট্রাম্প তখন তাকিয়ে আছেন কাতারের দোহার দিকে। আফগানিস্তান থেকে সম্মানের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারলে সেটা তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে সাহায্য করতে পারে। দোহায় খলিলজাদের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিদের আলোচনায় উভয় পক্ষের সমঝোতার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। আসলে মূল সমঝোতা হচ্ছে ইসলামাবাদে। যত দূর ঠিক হয়েছে, চুক্তি-পরবর্তী ১৫ মাসে ন্যাটোর সব সৈনিক বাড়ি ফিরে যাবে। তাদের এই বাড়ি ফেরা দক্ষিণ এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের খানিকটা গুটিয়ে যাওয়াও বটে। ফলে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন করে সমীকরণ ঘটতে থাকবে। ছদ্ম যুদ্ধের আড়ালে ছোট ও মাঝারি শক্তিরা তখন নতুন করে শক্তি পরীক্ষায় নামবে। কাশ্মীর অনেকগুলো ফ্রন্টের একটি মাত্র।

আসন্ন চুক্তিতে তালেবানদের সামান্যই ছাড় দিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ‘উগ্রবাদীদের সহায়তা নয়’—কেবল এটুকু অঙ্গীকার করছে তারা। অবশ্য এই ‘সহায়তা না করা’র বিরাট ফর্দ থাকবে। সেসব মানতে তালেবানদের আপাতত সমস্যা নেই। বিনিময়ে তাদের হারানো ‘আমিরাত’ সম্মানের সঙ্গে ফিরে পেলেই হলো। হয়তো তা তাৎক্ষণিক হবে না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। এটা যতটা তাদের শক্তিমত্তার গুণে, তার চেয়েও বেশি ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ট্রাম্পের বাস্তববাদিতার কারণে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন আফগান ফ্রন্টে পাকিস্তানের ভূমিকার গুরুত্ব মেনে নিয়েছে। পাকিস্তানও আফগানিস্তানে বন্ধুভাবাপন্ন সরকার ফিরে পাওয়ার বিনিময়ে কাশ্মীর বিষয়ে কণ্ঠ বিস্ময়করভাবে নমনীয় রেখেছে। আর ভারত মুহূর্তটি ব্যবহার করেছে ভালোভাবে।

কেউ কেউ মনে করছেন, আফগান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করায় ভারত প্রত্যুত্তর দিয়েছে কাশ্মীরকে তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ায় ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ ঘোষণা করে। কাশ্মীর ও আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক দর-কষাকষিতে আপাতত ছেদ টেনে দিয়েছেন অমিত শাহ। এই ভাষ্যটি সত্য-মিথ্যা যা–ই হোক, শেষ হাসি কে হাসবে, সেটা কেবল ভবিষ্যৎই জানে। দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হাতে পেয়ে অমিত শাহ সচেতনভাবে মোদিকে ঝুঁকিতে ঠেলে দিলেন কি না, সেটাও বিরাট প্রশ্ন হয়ে উত্তর খুঁজবে সামনের দিনগুলোতে। তবে কাশ্মীরের ঘটনাবলি কাবুলে ভারতের ঘনিষ্ঠদের বেশ কোণঠাসা অবস্থায় ফেলেছে। যার সাক্ষী সাবেক আফগান গোয়েন্দাপ্রধান আমরুল্লাহ সালেহকে সম্প্রতি খুনের চেষ্টা—যে ঘটনায় পাঁচতলা ভবনটি উড়ে গেলেও তিনি বেঁচে যান—কিন্তু ২০ ব্যক্তি মারা গেছে এবং ৫০ জন আহত হয়েছে। সালেহ বরাবরই আফগানিস্তানে ভারতের বর্ধিত ভূমিকার পক্ষে বলতেন। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে। ঘানি টুইটারে হামলাকারীদের ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করে অস্পষ্ট একটা বার্তা দিলেও আমরুল্লাহ সালেহকে হত্যাচেষ্টার বার্তাটি স্পষ্ট। নয়াদিল্লির পত্রিকাগুলোও সেটা বুঝেছে। সেগুলোতেই লেখা হচ্ছে, ৫ জুলাইয়ের পর কাবুলে কেউ আর শান্তিচুক্তির বিষয়ে নয়াদিল্লির মতামত নেওয়ার কথা উচ্চ স্বরে বলছে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারকে টিকিয়ে রাখতে গত ১৮ বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে ভারত। যার মধ্যে আছে কাবুলে পার্লামেন্ট ভবনটি তৈরি করে দেওয়ার ঘটনাও। সেপ্টেম্বরে শান্তিচুক্তি হয়ে গেলে এই ভবনে ঢুকবে তালেবানরাও। ঘানি সরকার এবং তার দেশি-বিদেশি ‘মিত্র’দের প্রভাবের পরিসর কমে যেতে বাধ্য তখন। দৃশ্যটি ৩০ বছর আগের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে কাবুলের বয়োজ্যেষ্ঠদের—যখন নয়াদিল্লি ‘নজিবুল্লাহ সরকার’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল—কিন্তু আফগানিস্তানে সবাই জানত পরিস্থিতি মুজাহিদিনদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের সমর বিশারদদের বোঝাপড়া হলো, কাশ্মীর প্রশ্নে তাদের যে ধরনের মিত্র প্রয়োজন, সেটা হতে পারে ভবিষ্যতের আফগানিস্তান। তাই আপাতত এক পা পিছিয়ে দুই পা এগোতে চায় তারা। যেকোনো মূল্যে আফগানিস্তানে নিজের একচেটিয়াত্ব ফিরে পেতে ইচ্ছুক পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নেওয়ামাত্র কাবুলের পুতুল সরকার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থেই ইসলামাবাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যে সরকারকে তালেবানদের ইচ্ছানুযায়ী শান্তি আলোচনায় কোনো পক্ষ হিসেবেই রাখা হয়নি। ফলে চুক্তি-পরবর্তী এক-দুই বছরের মধ্যে অনিবার্যভাবে সেখানে তালেবানদের নেতৃত্বে নতুন সরকার আসবে। এটা পাকিস্তানকে সামনের দিনগুলোতে কৌশলগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে রাখবে। ভারতের প্রতি ইমরান খানের পুনঃপুন সমঝোতার আহ্বান তাই অতি পরিকল্পিত। বিমান হামলার মুখেও পাকিস্তান ধৈর্য ধরছে। হয়তো কোনো যুদ্ধে তারা আর হারতে চায় না। ইসলামাবাদ মনে করছে, ভারতের লোকসভায় ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ’ প্রত্যাহার করলেই কাশ্মীর প্রশ্ন শেষ হচ্ছে না। একটি শক্তি পরীক্ষার শঙ্কা থাকছেই। তার স্বরূপ কী হবে, সেটা অনেকখানি নির্ভর করবে সামনের বছরগুলোতে ভারত-চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান আন্তসম্পর্কের ওপর। তবে কাশ্মীরে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে নিঃশেষ করে নয়াদিল্লি সেই পরিস্থিতিই ডেকে এনেছে, যা এত দিন পাকিস্তানের জেনারেলরা কষ্ট করেও পুরোপুরি তৈরি করতে পারছিলেন না। গত ৬ আগস্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এর প্রদায়ক সম্পাদক প্রতাপ ভানু মেহতা সেটাই বললেন ছোট বাক্যে: ‘মোদি সরকার কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব অনেক বাড়িয়ে দিল।’

ইতিহাসের এটা বড় কৌতুক যে, ৪৮ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক অঞ্চলে প্রতিপক্ষের অনুরূপ ভুল থেকে লাভবান হয়েছিল ভারত।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক