শুধু খাদ্য নয়, পুষ্টিও চাই

কোনো স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে আপনি জানতে চাইলেন, ওদের পছন্দের খাবার কী। সাধারণত ওরা জাঙ্কফুড বা ভাজাপোড়া খাবারের কথাই বলবে। শাকসবজি, মাছ-ভাত-ডাল, দুধ-ডিম তেমন গুরুত্ব পাবে না। অথচ পুষ্টির জন্য এই খাবারগুলোই বেশি দরকার। সেদিন প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা-২ নিয়ে আলোচনা হয়। সহযোগিতায় ছিল কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও সিএসএ-সান। সেখানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউট্রিশন কাউন্সিলের সহকারী পরিচালক আকতার ইমাম তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ১০ জন শিক্ষার্থীর পছন্দ জাঙ্কফুড, আর ৬ জন বলেছে শাকসবজির কথা। 

আলোচনায় জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মো. শাহনেওয়াজ বললেন পুষ্টি হলো উন্নয়নের বনিয়াদ। আমরা সাধারণত এভাবে পুষ্টির বিষয়টি দেখতে অভ্যস্ত না। মনে করি পেট ভরে ডাল-ভাতই যথেষ্ট। সেখানে যে আলাদাভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের দরকার আছে এবং পুষ্টির সঙ্গে যে উন্নয়নের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, সেটা কে ভাবে? 

পুষ্টি আর উন্নয়নের মধ্যে যোগাযোগটা কী? অনেকে ভাববেন এটা গৎবাঁধা একটা কথা। কিন্তু পুষ্টিবিদ ও গবেষকেরা দেখেছেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ যে খর্বকায়, মানে উচ্চতায় খাটো, কৃশকায়, সহজেই অসুখ-বিসুখে ভোগে, তার একটা অন্যতম কারণ পুষ্টির অভাব। খর্বকায়, দুর্বল মানুষ নিজ জীবনে খুব বড় কিছু করতে পারে না, অর্থনীতিতেও তেমন অবদান রাখতে পারে না। 

আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের উচ্চতা দেখুন। সেরা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১ দশমিক ৯ মিটার বা প্রায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। আমেরিকার প্রথম ৪৪ জন প্রেসিডেন্টের উচ্চতা গড়ে ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি, বলা যায় প্রায় ৬ ফুট। তাদের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বুদ্ধিমত্তা বা আইকিউ সবচেয়ে বেশি, ১৮২ পয়েন্ট। তাঁর উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উচ্চতারও একটি সম্পর্ক আছে। পুষ্টিকর খাবার শুধু উচ্চতা নয়, বুদ্ধিমত্তাও বাড়ায়। মস্তিষ্কের উৎকর্ষ সাধনে পুষ্টির একটা বড় ভূমিকা আছে। তাই সব দিক থেকে সফল হতে হলে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দরকার। 

বাংলাদেশ আমেরিকা নয়। কিন্তু আমাদের আশপাশের কিছু দেশের উদাহরণ দেখুন। একসময় চীন, জাপান, থাইল্যান্ডের মানুষ বেশির ভাগই ছিল খাটো। কিন্তু ক্রমে তারা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনে। প্রাণিজ প্রোটিন, ফলমূল, শাকসবজির দিকে নজর দেয়। এখন সেই সব দেশের মানুষের গড় উচ্চতা অনেক বেড়েছে। ওরা অর্থনীতিতেও প্রথম সারিতে উঠে যাচ্ছে। 

আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার কমছে। মানুষ এখন মোটামুটি দুই বেলা খেতে পায়। কিন্তু পুষ্টিকর খাবারের দিকে যেতে হবে। প্রতিদিন একটি ডিম, মাছ-মাংস, শাকসবজি খেতে পারলে মানুষের গড় উচ্চতা বাড়বে, রোগ–শোকে কম ভুগতে হবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগও বাড়বে। 

এ জন্যই দেশবাসীর, বিশেষভাবে গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করার বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। ২২টি মন্ত্রণালয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী এবং সিভিল সোসাইটি সমন্বিতভাবে কাজ করছে। এসব কথা সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে আলোচিত হয়। 

আমাদের সমস্যা দুটি। একদিকে সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য কম। অন্যদিকে মোটামুটি সচ্ছলদের সাধ্য থাকলেও সাধ কম। মানে, পুষ্টির বিষয়ে সচেতনতার অভাব খুব বেশি। এই যে শুরুতে স্কুলশিক্ষার্থীদের কথা বললাম, ওরা পুষ্টিকর খাবারের কথাই হয়তো শোনেনি। না হলে তো তাদের কাছ থেকে শুনতাম ডিম-দুধ-মাছ-মাংসের কথা। 

কিন্তু এই সচেতনতা আসবে কোথা থেকে? আমাদেরই সেটা করতে হবে। অনেক পোলট্রি খামার প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন স্কুলে টিফিনের সময় শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের একটা করে ডিম খাওয়ায়। এটা তাদের দায়িত্ববোধ থেকেই করে। এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানই অবদান রাখতে চায়। আমরা যদি শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন এলাকায় জন-উদ্যোগ গ্রহণ করি, তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব। 

শহরগুলোতে সমস্যা দুই ধরনের। একদিকে ছিন্নমূল অসচ্ছল মানুষ অর্থাভাবে পুষ্টিকর খাবার পায় না। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যদিকে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ওজন বেড়ে যাচ্ছে। তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। এখানে পুষ্টিসচেতনতা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। 

একটা সহজ ব্যাপার দেখুন। সন্তান জন্মের পর প্রথম ছয় মাস যদি মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু না খাওয়ানো হয়, তাহলে তার উচ্চতা অনেক বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি প্রথম ছয় মাস পানিরও দরকার পড়ে না। এরপর ভাত-মাছ-দুধ-ডিমের সঙ্গে আরও বছরখানেক মায়ের দুধ খেলে তার স্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চতা বাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমরা এসব জানি না বা জানলেও পাত্তা দিই না। অবশ্য নবজাতকের খাওয়ার বিষয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে। শিশু জন্মের আগে থেকেই সন্তানসম্ভবা মায়ের পুষ্টির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। দরকার হলে পরিবারের অন্য সবার খাবার থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে হলেও তা করা দরকার। ভবিষ্যৎ সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বামী ও পরিবারের অন্যদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তাহলে আমাদের খর্বাকৃতির সমস্যা অনেকটা দূর করা সম্ভব। 

সরকার দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা (২০১৬-২৫) গ্রহণ করেছে। কাজ চলছে। মনে রাখতে হবে, এটা বহু খাতভিত্তিক কাজ। মানে ২২টি মন্ত্রণালয়ের কাজ। তার সঙ্গে রয়েছে সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স ও সান (এসইউএন, স্কেলিং আপ নিউট্রিশন)। আমরা আশা করব, একেবারে উঁচু পর্যায় থেকে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত সব পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করলে লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব। দেশে খর্বকায় মানুষের সংখ্যা অবশ্যই কমবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি আরও শক্তিশালী হবে। 

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক