প্রতিক্রিয়া: 'উন্নয়নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম আলো পত্রিকার ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘উন্নয়নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামে আনু মুহাম্মদের নিবন্ধের প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তাঁর নিবন্ধে সার্বক্ষণিক ভয়ভীতি, সন্ত্রাস ও জোরজবরদস্তি উপেক্ষা করে ২৭ আগস্ট শিক্ষার্থীদের মশাল মিছিল হওয়া এবং এর প্রেক্ষাপট হিসেবে ‘মাস্টারপ্ল্যান’ আর ‘অধিকতর উন্নয়ন পরিকল্পনা–এর নামে সর্বজনের টাকা লুট এবং বিপজ্জনক নির্মাণকাজে কতিপয় গোষ্ঠীর তৎপরতার অভিযোগ করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এই অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন। 

নিবন্ধকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রার প্রারম্ভিকতা উল্লেখপূর্বক মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা এবং কাজের ধারাবাহিকতায় মহাপরিকল্পনার মূল বিন্যাস ভেঙে অবকাঠামোগত নির্মাণের বিবরণ দিয়ে যে সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তা বিগত সময়ের কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। বর্তমান কর্তৃপক্ষের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, প্রকৃতি, জলাভূমি, পাখপাখালি, মাছসহ জলজ নানা প্রাণ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুটি লেক ইজারামুক্ত রাখা হয়। বিগত পাঁচ বছরে নানা ধরনের ফুল, ফল, বনজ ও ঔষধি গাছের প্রায় ১০ হাজার চারা লাগানো হয়েছে। স্মর্তব্য যে ভবন নির্মাণ ও বিভাগ খোলার মধ্যে সমন্বয়হীনতার দায় বর্তমান কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায় না। কারণ, বর্তমান কর্তৃপক্ষ নতুন কোনো বিভাগ চালু করেনি। বিগত সময়ের কর্তৃপক্ষ যেসব বিভাগ খুলেছে, বর্তমান কর্তৃপক্ষ সেসব বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য ভবন নির্মাণ এবং কোনো কোনো ভবন সম্প্রসারণ করে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের বসার জায়গার সংকট নিরসনের চেষ্টা করেছে।

নিবন্ধে নতুন কয়েকটি হল নির্মাণের পরও শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট দূর না হওয়া প্রসঙ্গে সেশনজট, শিক্ষার্থীরা পাস করেও হল না ছাড়া, বেশির ভাগ হলে শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশাসন চালানো, ছাত্রসংগঠনের একক দাপট ইত্যাদির অভিযোগ করা হয়েছে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘকাল ধরে উল্লিখিত সমস্যা বিরাজ করছে। এ সমস্যা রাতারাতি নিরসন করা সম্ভব না হলেও বর্তমান কর্তৃপক্ষ তা দূর করার চেষ্টা করছে। বর্তমান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের গণরুমে (একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর বসবাস করা) থাকার সমস্যা সমাধানকল্পে চলমান উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায় ছাত্রছাত্রীদের ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের গুরুত্ব দিয়েছে। গণরুমে বসবাসের সমস্যা নিরসনকল্পে প্রস্তাবিত ছয়টি হলের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। এই ছয়টি হলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে না এবং নতুন বিভাগও খোলা হবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একনেকে’ পাস ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার নতুন উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর-পরিকল্পনা, পরিবেশবিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, ভূগোল ও পরিবেশ, অর্থনীতি, চারুকলাসহ অনেক বিভাগের শিক্ষকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে যে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের মতামত নেওয়া হয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করার অভিযোগ সঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছে যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের বহিঃস্থ বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এই উন্নয়ন মহাপরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৃঢ়ভাবে জানাচ্ছে যে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার এই অধিকতর উন্নয়ন পরিকল্পনার কোনো কাজ অপরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করা হয়নি। এই উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার আওতায় যেসব নির্মাণকাজ রয়েছে, সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই, ডিজিটাল সার্ভে, মাস্টারপ্ল্যান, স্থান নির্বাচন, সয়েল টেস্ট, আর্কিটেকচারাল ডিজাইনসহ সব স্তরের কাজ বুয়েটের অধ্যাপক শেখ আহসান উল্লাহ মজুমদারের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে। এই টিমে আরও রয়েছেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ, প্ল্যানার সামিনা মজুমদার, স্থাপত্যবিদ মাহেরুল কাদের প্রিন্স ও ফাতেমা তাসমিয়া। এ ছাড়া বুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনাবিদদের আরও একটি টিম এই উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে। এই টিমে ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে ড. অপূর্ব কে পোদ্দার, আর্কিটেক্ট আহাম্মেদ আল মোহায়মেন ও নয়না তাবাসসুম। এই স্টাডি গ্রুপে পরিবেশবিদ, প্রাণিবিদ, ভূগোলবিদ, ইকোনমিকস এক্সপার্ট ও স্থাপত্যবিদেরা রয়েছেন। 

এই মহাপরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে একনেক কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। তিন বছর যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ উন্নয়ন প্রকল্প ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর একনেকের অনুমোদনের পর ১২ জানুয়ারি ২০১৯ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। একনেক সভায় অনুমোদিত ও চূড়ান্তকৃত প্রকল্পের বিরোধিতা করা অথবা এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানো মোটেই উচিত নয়। এ ছাড়া গত জুন মাসে অনুষ্ঠিত সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে এ উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। সম্মানিত সিনেট সদস্যরা এ বিষয়ে কথাও বলেছেন।

নিবন্ধে গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাচার্য মহোদয়কে জড়িয়ে প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা মোটেই সত্য নয়। এ প্রকল্পের টাকা এখন পর্যন্ত নির্মাতা সংস্থা বরাবর ছাড় করা হয়নি। সুতরাং এ প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নই ওঠে না। কর্তৃপক্ষ মনে করে, এ ধরনের অসত্য অভিযোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও একজন সৎ, নিষ্ঠাবান এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী উপাচার্যের সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

নিবন্ধকার তাঁর লেখার শেষ অংশে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বা সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়, এর উন্নয়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা-ও সর্বজনের। এর সুষ্ঠু বিকাশের সঙ্গে দেশের সর্বজনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বহু প্রজন্মের স্বার্থ জড়িত’ বলে মন্তব্য করেছেন। কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রেও অভিন্ন মত পোষণ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও অজানা নয় যে একসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিরানভূমি। বিগত প্রায় তিন দশকে এনজিওসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে অব্যাহতভাবে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সবুজ ক্যাম্পাসে রূপলাভ করেছে। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র গাছ রয়েছে। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসে অসংখ্য গাছের চারা রোপণ করা হয়। ক্যাম্পাসে নানা ধরনের বৃক্ষের মধ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একাশিয়া ও ইউক্যালিপটাস গাছও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও জানাচ্ছে যে জলাধার, বন্য প্রাণী ও প্রাণ-প্রকৃতি গবেষণা এলাকা এবং সংরক্ষিত বনভূমি বাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মাত্র ২১ শতাংশ ভূমি অবশিষ্ট রয়েছে। কাজেই যেখানেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক না কেন, সেখানেই কিছু গাছ কাটতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়নের সময় যত গাছ কাটা হবে, তার আশপাশে দ্বিগুণ পরিমাণ গাছ লাগানো হবে।

পরিশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ কথা জানাচ্ছে যে শিক্ষা, গবেষণা ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের এই মহাপরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণে বিশ্ববিদ্যালয় আমূল বদলে যাবে। উচ্চশিক্ষার পাঠদান কাঠামো, আবাসনব্যবস্থা, গবেষণা ও ছাত্রছাত্রী ভর্তির দ্বার আরও সম্প্রসারিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্প্রসারণ ও কল্যাণমুখী এই কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে সবাইকে অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

মো. আবদুস সালাম মিঞা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিসের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)