রাষ্ট্রীয় পদক ও বাছাই প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা

সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং তাঁর একজন অধস্তন নারী সহকর্মীর অনৈতিক সম্পর্কের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং এ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সরকার দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ওই ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। সে জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন করা হয়েছে। আলোচিত অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সরকার পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। 

একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে ব্যবস্থা নেওয়ার কিছু সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান আছে। এতে একটু সময় লাগলেও তদন্ত সঠিক হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। পরবর্তী সময়ে আইন-আদালতের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা যায় না। আবার সে তদন্তপ্রক্রিয়া অযাচিত বিলম্বিত হলে চুপসে থেমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তাই আলোচ্য ঘটনায় এখন পর্যন্ত সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাকে সঠিক ও সময়োপযোগী বলেই মনে করি। 

এ প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে, এই কর্মকর্তা সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ ডিসি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। পেয়েছেন বিভাগীয় শুদ্ধাচার পদক। পদক প্রসঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদক প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। সরকারের দেওয়া পদক সরকার প্রত্যাহার করে নিতেই পারে। তবে এই কর্মকর্তা পদকটির জন্য কীভাবে বিবেচিত হলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। তাঁর আলোচিত অনৈতিক সম্পর্ক তো আকস্মিক তৈরি হয়নি। এটি অতি সাম্প্রতিক কালের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয় বলে ওয়াকিবহাল মহল দাবি করছে। তাঁর অফিসকক্ষে অতিরিক্ত একটি বিশ্রামকক্ষ সংযোজনের কোনো সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না। জেলা শহরগুলোতে ডিসিসহ জেলা পর্যায়ের প্রায় সব কর্মকর্তা দুপুরের খাবার বাসায় গিয়ে খেয়ে আসেন। সংশ্লিষ্ট কালেক্টরেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এবং জেলার বহু বিশিষ্টজন সেই ডিসির অনৈতিক জীবনযাপনের ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত। প্রশ্ন থাকে, এ ক্ষেত্রে তাঁকে শুদ্ধাচার পদকের জন্য যাঁরা মনোনয়ন দিলেন, তাঁরা কি এর কিছুই জানতেন না? না জানা থাকলে তাঁদের এ ধরনের বাছাই কমিটিতে থাকার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

 সাধারণ প্রশাসনে আগে কোনো পদক-পদবি ছিল না। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রের ধারণা থেকে শুদ্ধাচারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য ২০১৭ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটা চালু করে। কোনো ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থী না থাকলে সেটা খালি থাকবে, এটা পরিপত্রে লিখে দেওয়ার আবশ্যকতা ছিল না। বাছাই কমিটিই সিদ্ধান্ত নিতে পারত। ডিসিদের ক্ষোভ আছে, তাঁদের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস করার জন্য অনেকেই সচেষ্ট। ক্ষোভটি অমূলক নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা থেকে এমনটা ঘটে চলেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে তাঁদের দু-চারজন যখন নিজেদের মর্যাদা ধুলায় লুটাতে সক্রিয় হন, তখন অন্যদের কতটা দোষ দেওয়া যাবে? 

মাত্র কয়েক মাস আগে উত্তরাঞ্চলের একজন ডিসি তাঁর অধীনস্থ নারী সহকর্মীকে মেসেঞ্জারসহ অন্যান্য মাধ্যমে অশালীন প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। অপারগ হয়ে সেই নারী কর্মকর্তা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছিল। এরপর বিষয়টি আর এগিয়েছে বলে আমরা জানি না। হয়তোবা সময়ান্তরে পদোন্নতিও পেয়ে যাবেন সেই কর্মকর্তা। 

তবে এই নিবন্ধ পদক-পদবি বিতরণেই সীমিত রাখতে চাই। বেসামরিক প্রশাসনে প্রতিবছরই বেশ জাঁকজমকভাবে উদ্‌যাপন করা হয় পুলিশ সপ্তাহ। সে সপ্তাহে অনেক কার্যক্রমের মধ্যে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল, প্রেসিডেন্টস পুলিশ মেডেল থেকে অনেক পদক বিতরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ পদকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এটি দোষেরও ছিল না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পদকপ্রাপ্তদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। কেউবা তালিকায় স্থান পান শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায়। অথচ এখানে পেশাগত দক্ষতা ও লক্ষণীয় সততাই প্রধান মানদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু বিপরীতটা ঘটছে বলে পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরে অসন্তোষের কথা গত পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনে এসেছিল। 

যে দুজন কর্মকর্তা পদক পেয়েছেন তাঁদের পদকপ্রাপ্তির পেছনের কৃতিত্ব হচ্ছে, একজন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার বিশ্বনন্দিত ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলমকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কাজে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন, আরেকজন সহকারী কমিশনার কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন নেতাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। ঢাকায় দুজন ছাত্র বেপরোয়া গাড়িচালকের কারণে মৃত্যুবরণ করায় যে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্রবিক্ষোভ হয়, তারই ছবি তুলেছিলেন শহিদুল আলম। আল-জাজিরাকে তিনি একটি সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন। এগুলো রাষ্ট্রবিরোধী কি না, এর বিচার করবেন আদালত। তবে শহিদুল আলমের মতো একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে ব্যাপক শক্তি বা কৌশল প্রয়োগের আবশ্যকতা ছিল না। ঠিক তেমনি আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পরপর সরকারপ্রধান সংসদে ঘোষণা দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেন। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হলে আরেকবার অস্থিরতা দেখা দেয়। তা-ও সরকার দ্রুতই এর নিষ্পত্তি করে ফেলে। সে আন্দোলনের একজন নেতার গ্রেপ্তারকে বিশেষ বীরোচিত ঘটনা হিসেবে দেখার আবশ্যকতা ছিল না। নৈতিক দিক বিবেচনায় নিলে এ দুই ক্ষেত্রে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আর সেই কর্মকর্তারা নৈতিক দিক বিবেচনায় এ জন্য বিশেষ কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না। বলতে হয়, তাঁরা অতি সাধারণ রুটিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর জন্য কোনো পদক দেওয়া অযৌক্তিক। 

এরপর একটু আলোচনায় আনতে হয় আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রসঙ্গ। এ পদকপ্রাপ্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অবদান ব্যতিরেকেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়। তবে স্বাধীনতার নামে যে পদকটি, তা কোনো স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির হাতে যাক, এটা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এমন আরও থাকতে পারে, তবে ১৯৮০ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একজন ‘পীর’কে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ পদক প্রদানের বিষয়টি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে বারবার। 

এটা ঠিক যে সেই ‘পীর সাহেব’ তাঁর অঞ্চলে বেশ কিছু মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষা সম্প্রসারণে অবদান রেখেছেন। তিনি সম্মানিত লোক। তাঁর পরিবারের অর্থবিত্তও বেশুমার। আমাদের দেশে তাঁদের আয়করের আওতায় আনা হয় বলে জানা যায় না। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া একমাত্র ব্রিটিশ আইসিএস কর্মকর্তা হেচ বার্নওয়েল ১৯৪৭-৪৮-এ বরিশালের ডিসি ছিলেন (তখন ডিএম বলা হতো)। তাঁর একটি আত্মজীবনীতে দেখা যায়, পাকিস্তান সরকার নতুন কারেন্সি নোট চালু করলে পীর সাহেবের লোকজন কয়েকটি নৌকায় করে থলে ভর্তি টাকা নিয়ে বরিশাল ট্রেজারিতে পুরোনো টাকা বদলাতে আসেন। ১৯৭১ সালে পীর সাহেবের সে বাড়িটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট। ১৯৮০ সালে সেই পীর সাহেবকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার পর পানি অনেক গড়িয়েছে। সরকার গেছে একের পর এক। কিন্তু কেউই এটা বিবেচনায় নিয়েছে, এমনটা মনে হয় না। ধারণা করা হচ্ছে, প্রয়াত সেই পীর সাহেবের বংশধরেরা এখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। না হলে অনেক আগেই পুরস্কারটি প্রত্যাহার করে নেওয়া সংগত ছিল। বাধা কোথায় তা বোধগম্য নয়। 

সব কটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সময়, কাল ও পাত্র ভিন্ন। তবে পদক-পদবি বিতরণ ও বাছাই প্রক্রিয়ায় যে অনেক ক্ষেত্রেই শুদ্ধতা থাকে না, তা লক্ষণীয়। কিন্তু একই ভুল বারবার হবে কেন? 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব