ব্যালটকে যে কারণে পুতিনের এত ভয়

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ায় ৮ সেপ্টেম্বর মিউনিসিপ্যাল ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নির্বাচন। এ নির্বাচন ঘিরে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। একদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। অন্যদিকে, সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে সরকারি দলের প্রার্থীদের ভরাডুবির আশঙ্কা। একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে, কোনো বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ জনগণের রায় ও বিরোধী প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার ভয়ে ভীত হয়ে সরকার কারসাজি করে বলেই গত কয়েক দশকে রাশিয়ায় কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। 

নির্বাচনে জিততে মস্কো বহু আগে থেকে যেসব কূটকৌশল প্রয়োগ করে আসছে, তা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। বহু আগে থেকেই তারা নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকে। এবারও নিয়েছে। যেমন: ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এগিয়ে আনা হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে বিরোধীরা যাতে সংগঠিত হতে সময় না পায়, সে জন্যই এটি করা হয়েছে। এর বাইরে কর্তৃপক্ষ নতুন কিছু কৌশলও হাতে নিয়েছে। যেমন: নির্বাচনপ্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য কিছু ভুয়া প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে। পুতিনের দলের অনেক অনুসারীকে ব্যালটে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে উল্লেখ করে দাঁড় করানো হচ্ছে। 

এবারের স্থানীয় নির্বাচনে একটি নতুন মোবাইল ডিজিটাল ভোটিং সিস্টেম অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে ভোটাররা যেকোনো জায়গা থেকে অনলাইনে ভোট দিতে পারবেন। সমালোচকেরা বলছেন, ভোট কারসাজি করার উদ্দেশে্যই এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এ নির্বাচনে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নির্বাচন কমিটি বহু প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। শেষ পর্যন্ত যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পেরেছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে আটক করে মধ্যরাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কারও কারও বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। 

এত কিছুর পরও কাজ হয়নি। ২৮ জুলাই হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে নির্বাচন কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এর জবাবে সরকার বিপুলসংখ্যক স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পুলিশ মোতায়েন করে এবং বিরোধীদলীয় নেতাদের পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিক্ষোভকারীকে আটক করে। এর দুই সপ্তাহ পরে মস্কো কর্তৃপক্ষ জনসভা করতে দেওয়ার অনুমতি দেয়। এরপরই প্রায় ৬০ হাজার মানুষ সরকারের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাজপথে জড়ো হয়। ওই বিক্ষোভের অনুমতি থাকার পরও সেখানে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা এবং কয়েক শ লোককে আটক করে। এরপর থেকেই বিরোধী দলের যেকোনো ধরনের জনসমাগম সরকার নিষিদ্ধ করেছে। 

এর মাধ্যমে ক্রেমলিন স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: এখানে হংকংয়ের মতো ব্যাপক বিক্ষোভ হতে দেওয়া যাবে না, এখানে ইস্তাম্বুলের মতো স্বচ্ছ নির্বাচন (যেখানে বিরোধীরা জয়ী হয়েছে) হতে দেওয়া যাবে না। এ লক্ষ্য অর্জনে ক্রেমলিন বড় ধরনের দমন–পীড়নের কথা ভাবছে। ক্রেমলিনের এ অবস্থানে হয়তো কেউই অবাক হবে না। এটি কর্তৃত্ববাদী শাসকের স্বাভাবিক চরিত্র। এ ব্যবস্থায় নিষ্ঠুর বাহিনী সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের নিষ্ঠুরতা জারি রাখবে এবং জনগণ ধীরে ধীরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থানকে সুসংহত করবে। 

যেকোনো দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে রাশিয়ায় ‘পুতিনিজম’ এখন পড়তির দিকে। এটি গত মে মাসে সরকার পরিচালিত পাবলিক ওপিনিয়ন সেন্টারের জরিপেও ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের জনপ্রিয়তা ২৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। 

জনগণের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ধারণা নিতে ক্রেমলিন এ সেন্টারকে ব্যবহার করে এবং এসব জরিপের ফল কদাচিৎ জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। ওপিনিয়ন সেন্টারের সর্বশেষ জরিপের ফল ফাঁস হওয়ার পর সেন্টারের প্রতি ক্রেমলিন ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং সেন্টারকে আবার জরিপ করতে বলে। এর কয়েক দিন পরই একই ওপিনিয়ন সেন্টারের জরিপে পুতিনের জনপ্রিয়তা ৭২ শতাংশ দেখানো হয়েছে। 

এরপর জুন মাসে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পুতিন তাঁর বার্ষিক ‘সরাসরি প্রশ্নোত্তর’ অনুষ্ঠানে হাজির হন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাগরিকেরা সরাসরি প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করতে পারেন। এ অনুষ্ঠান চলাকালে এ টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে ১২ হাজার লাইক পড়েছে। ডিজলাইক পড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজারটি। কিছু বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন, এ অনুষ্ঠানের দর্শকদের মাত্র ৭ শতাংশের কাছে পুতিন জনপ্রিয়। 

হয়তো হংকং এবং ইস্তাম্বুলের কথা সরকার মাথায় রেখেছে। ৩০ বছর আগে মিখাইল গর্বাচেভ সীমিত আকারে অবাধ নির্বাচন দিয়ে নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে কী বিপদে পড়েছিলেন, সে কথা পুতিন এবং তাঁর সহযোগীদের নিশ্চয়ই মনে আছে। এর আগে যে কয়টি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে, তা স্পষ্টতই প্রহসন। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু গর্বাচেভ সোভিয়েত আইনসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু নির্দলীয় লোককে রাখতে চেয়েছিলেন। এটি করতে গিয়ে তিনি একটি নতুন আইনসভা পরিষদ তৈরি করেছিলেন। তাতে মোট ২ হাজার ২৫০ প্রতিনিধি রাখা হয়। এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ আসন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। বাকি দুই–তৃতীয়াংশে উন্মুক্ত ভোটের জন্য রাখা হয়। উন্মুক্ত আসনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারপরও ১৯৮৯ সালের মার্চে যখন ভোট হলো, তখন দেখা গেল সরকারদলীয় প্রার্থীদের ৩০০ জন হেরে গেছেন। গর্বাচেভ এ নতুন নির্বাচনকে তাঁর সংস্কার উদ্যোগ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টার পথের বিজয় বলে দাবি করেছিলেন। তবে কট্টরপন্থীরা এ নতুন স্বাধীনতা ও বিরোধীদের জায়গা করে দেওয়ার বিষয়টিতে তখনো খুশি হননি, এখনো হচ্ছেন না। 

ক্রেমলিনের একেবারে ভেতরকার মানুষ এবং পুতিন সরকারের অন্যতম রূপকার ভ্লাদিস্লাভ সারকোভ সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, কেবল ‘মিলিটারি-পুলিশ রাষ্ট্র’ হিসেবেই রাশিয়াকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে এবং পুতিনই একমাত্র নেতা, যাঁর ওপর রুশ নাগরিকেরা ভরসা করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘পুতিনিজম’ বা ‘পুতিনবাদ’ একটি নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাদের মতো এ মতাদর্শ আগামী কয়েক শতাব্দী টিকে থাকবে। 

ভ্লাদিস্লাভ সারকোভ পুতিনকে যতই ওপরে তুলুন না কেন, বাস্তবতা হলো পুতিনবাদে ধস নেমেছে। সরকারনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম হাজার চেষ্টা করেও এ ধস থামাতে পারছে না। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একচুলও সমালোচনা বরদাশত করে না। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার তফাত হলো যতটুকু সমালোচনা করলে তা সরকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় না, ততটুকু সমালোচনা রাশিয়া করতে দেয়। ক্রেমলিন এখন সেই ধরনের হুমকির আঁচ পাচ্ছে। এ কারণে ভয়ভীতি ছড়াচ্ছে। শুধু পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর না করে পুতিন ৩ লাখ ৪০ হাজার রুশ গার্ডের একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেছেন। ক্রেমলিন ভালো করেই জানে, প্রকৃত গণতন্ত্রের শুরু মানে পুতিনবাদের সমাপ্তি। এ কারণে বিরোধীদের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা ছাড়া কোনো পথ তাঁর সামনে নেই। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে পুতিন কি শেষ পর্যন্ত রেড স্কয়ারকে ‘রাশিয়ার তিয়েনঅানমেন স্কয়ার’ বানিয়ে ছাড়বেন? 

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মিখাইল খোদরকোভস্কি শিকাগোর লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক