কাকে জরিমানা করব আমরা?

নগরপিতারা এডিস মশা প্রতিরোধে শুরু করেছেন চিরুনি অভিযান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, যেখানেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাবে, সেখানেই জরিমানা করা হবে। পিছিয়ে নেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও। তিনি ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে দোষী মালিককে শুধু জরিমানা করেই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু বাড়ির বাইরে তাঁরা ডিএনসিসির তৈরি করা সতর্কতামূলক স্টিকার ‘এই বাড়ি/স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে’ এবং লাল চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরা নাগরিকেরা সত্যিই অপরিচ্ছন্ন থাকার অপরাধে অপরাধী। কারণ, আমরা আমাদের বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখি না। বাসার বারান্দা, ছাদ কিংবা জানালা দিয়ে নির্লজ্জভাবে ছুড়ে ফেলি ময়লা–আবর্জনা, বাসার ছাদের টবে, পুরোনো টায়ার কিংবা ড্রামে উদাসীনভাবে জমতে দিই বৃষ্টির পানি এবং এডিস মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করি। নিশ্চয়ই এ অপরাধ গুরুতর। তাই আমাদের জরিমানা করা, আমাদের দরজায় স্টিকার লাগানো কিংবা লাল চিহ্ন এঁকে দেওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের অপরাধী চিহ্নিত করার আগে এ বিষয়ে প্রকৃতপক্ষে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা তাঁদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার দরজায় লাল চিহ্ন কিংবা স্টিকার লাগিয়েছেন তো! তাঁদের জরিমানা করবে কে? কেননা, পত্রিকায় যেসব রিপোর্ট এসেছে, দেখা যায়, নগর ভবনের পাশেও ময়লা–আবর্জনার স্তূপ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে একটি ধারা যোগ করে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন।’ সংবিধান অনুযায়ী, জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর তাই রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সে দায় কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনাকারী অর্থাৎ সরকারের ওপরই বর্তায়। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সে দায়দায়িত্ব বহন করতে হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের মতে, রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বর মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ার পেছনে শুধু সিটি করপোরেশনই দায়ী নয়। এদের পাশাপাশি রয়েছে ঢাকা ওয়াসা, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক, রিহ্যাব, সড়ক বিভাগ, তিতাস, বিটিসিএল। মশার বংশবিস্তারে উর্বর ক্ষেত্র রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়; বিশেষ করে খাল, বক্স কালভার্ট ও ড্রেন। ঢাকা ওয়াসা সেদিকে নজর দেয় কি? ঢাকার নির্মাণাধীন ভবনগুলো যেন এডিস মশার উর্বর উৎপাদন ক্ষেত্র। চলছে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প। এসব কাজের কারণে অনেক স্থানে পানি জমে থাকছে। কিন্তু জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক, রিহ্যাব কেউই সেদিকে নজর দেয় না।

অন্যদিকে রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার তদারকি নিয়ে সিটি করপোরেশন আর ওয়াসার মধ্যে চলে টানাহ্যাঁচড়া। ভরা বর্ষাতেও চলে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য ঢাকা ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি। সেখানে মশারা ডিম পাড়ছে, বংশবিস্তার করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। একই অবস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তরের। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেউ কখনো জরিমানা করেছে বলে শুনিনি। তাই নাগরিকদের সেবা প্রদানে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রথমেই জরিমানা না করে জনগণের দরজায় স্টিকার লাগানো কিংবা জরিমানা করা কতটুকু যৌক্তিক, তা ভাববার অবকাশ আছে।

বাংলাদেশে মশার আধিপত্য নতুন কোনো বিষয় নয়। ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া কিংবা ফাইলেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের সঙ্গে পরিচয় অনেক পুরোনো এ দেশের মানুষের। আজ এডিস মশার বিষয়টি নতুনভাবে আলোচিত হলেও অ্যানোফিলিস এবং কিউলেক্স মশার উপদ্রবের সঙ্গে সেই শৈশব থেকেই আমরা পরিচিত। সেসব মশা কিন্তু এডিস মশার মতো আমাদের বাসাবাড়ির ভেতরে স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে না। সেসব মশা প্রতিরোধে সরকার এবং সিটি করপোরেশন কতখানি ব্যর্থ কিংবা সফল, সে কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশে মশা পরিস্থিতি বোঝার জন্য একটিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘুরে আসাই যথেষ্ট হবে। রোজ সকালে সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকটি যখন রাজার হালে নোংরা-ময়লা ফেলতে ফেলতে মহাসড়ক দিয়ে ছুটে চলে, তখন আমরা কাকে জরিমানা করব? সিটি করপোরেশনের কর নিয়মিত পরিশোধ করার পরও যখন কার্যকর মশার ওষুধ ছিটানো হয় না, তখন আমরা কাকে জরিমানা করব? পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্‌যাপনের অনেক দিন পরও যখন আমাদের গলির আশপাশে দুর্গন্ধময় নোংরা চাটাই কিংবা গোবর পড়ে থাকে, তখন আমরা কাকে জরিমানা করব? ২০০ টাকার মশারোধক ক্রিম যখন ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়, তখন আমরা কাকে জরিমানা করব?

ঢাকা শহরে বর্তমানে বর্জ্য তৈরির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৫০০ টন। প্রতিদিন তৈরি হওয়া বর্জ্যের মাত্র ৬০ শতাংশ সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে। সংগ্রহ না হওয়া বাকি ৪০ শতাংশ বর্জ্য অবৈধভাবে বাড়ির পাশের খানাখন্দে ডোবা-নালায়, ড্রেনে, রাস্তার পাশে, খোলা জায়গায়, জলাভূমিতে ফেলা হয়। সেখানে অবাধে জন্ম নেয় মশককুল। সচেতন নই বলে জরিমানার দায় যদি আমাদের নিতে হয়, তবে তার আগে আমাদের সচেতন করতে না পারার ব্যর্থতায় জরিমানা করা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থা, প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং কর্মকর্তাদের। এঁদের কেউবা ডেঙ্গু মশাকে এলিট উপাধি দিয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে শামিল করেছেন, কেউবা এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতাকে রোহিঙ্গাদের প্রজনন ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। দেশের সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতা অভিযানে জনগণের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। তবে শুদ্ধি অভিযান চালানোর আগে প্রথমে প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের নিজেদের শুদ্ধতা নিশ্চিত করা।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]