আমরা কোথায় চলেছি

আমরা প্রতিদিন রাতে দুঃসংবাদে ভারাক্রান্ত হয়ে ঘুমাতে যাই। ভাবি, পরের দিনটি ভালো যাবে। আমাদের আর দুঃসংবাদ পড়তে পড়তে কিংবা শুনতে শুনতে ঘুমাতে যেতে হবে না। কিন্তু পরদিন আরও বেশি দুঃসংবাদ, আরও ভয়ংকর দুর্ঘটনার খবর আমাদের মস্তিষ্কে অভিঘাত সৃষ্টি করে।

কয়েক দিন আগে বাংলামোটর মোড়ের ফুটপাতে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর পায়ের ওপর দিয়ে বাস চলে গেলে তাঁর এক পা কেটে ফেলতে হয়। একজন সুস্থ–সবল মানুষের এক পা কেটে ফেলা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। বাকি জীবন তাঁকে এই পা হারানোর যন্ত্রণা বইতে হবে। কিন্তু তারপরও এটুকু সান্ত্বনা যে তিনি বেঁচে আছেন। গত বৃহস্পতিবার বেপরোয়া চালকের বাসের নিচে মারা গেলেন ফারহা নাজ নামের চাকরিজীবী নারী ও পারভেজ রব নামের এক সংগীতশিল্পী। ফারহা নাজের দেড় বছরের কন্যাশিশুটি এখন কাকে আশ্রয় করে বড় হবে? শুক্রবারের পত্রিকায় এই মর্মান্তিক খবরের পাশাপাশি দুর্ঘটনা কমাতে টাস্কফোর্স গঠনের খবর দেশবাসীকে একটুও আশ্বস্ত করবে না। এর আগেও বহু কমিটি হয়েছে, বহু আইন হয়েছে, সড়কে দুর্ঘটনা কমেনি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে বছরে আট হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। একসময় ট্রেনযাত্রাকে নিরাপদ ভাবা হতো। এখন ট্রেনেও ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কে, ট্রেনের এসব দুর্ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার হয় না। গত বছর ছাত্র-তরুণদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন পাস করলেও তা কার্যকর করতে পারছে না পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের বিরোধিতার কারণে। আরও অনেক টাস্কফোর্সের মতো এটাও অকার্যকর উদ্যোগে পরিণত হবে।

২.

যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সরকার সক্ষম বলে এত দিন দাবি করা হতো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকার ১৯৯৮ সালে দেশব্যাপী বন্যার সময় সেই সক্ষমতার প্রমাণও রেখেছিল। সে সময়ে বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে ২ কোটি মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে আছে বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু একজন মানুষও মারা যায়নি। আর এবার ডেঙ্গুতে বহু মানুষ মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ-শিশু। ডেঙ্গু নিয়ে সরকার লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে। উচ্চ আদালত বারবার নির্দেশনা দিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেননি। যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে, তখনই জানা গেল ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা মারার ওষুধ সিটি করপোরেশনের ভান্ডারে নেই। যা আছে, তাতে মশা মরে না।

শুধু ডেঙ্গুর প্রকোপ বলি কেন? ঢাকার কোনো কিছুই ঠিকমতো চলছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে রাস্তায় যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। তারা আমাদের ভবিষ্যতের শান্তির জন্য বর্তমানকে হত্যা করছে। এভাবে পৃথিবীর কোথাও উন্নয়নকাজ চলতে পারে না। চলে না। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট ঘোষণার দিন দেখা গেল, মেয়র ৯৫ শতাংশ রাস্তাঘাট ঠিক আছে বলে দাবি করলে কাউন্সিলররা হইচই করে ওঠেন। আবার সাংবাদিকেরা সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি চাইলে কাউন্সিলররা তাঁদের প্রতি তেড়ে যান। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, সত্যি সত্যি তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে এতটা দায়িত্বহীন হতে পারতেন না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকা করেছে। তাতে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। প্রথম হলো সিরিয়ার দামেস্ক ও দ্বিতীয় নাইজেরিয়ার লাগোস। গৃহযুদ্ধে দামেস্ক বিধ্বস্ত। সেটি বসবাসের অনুপযোগী হতে পারে। ঢাকা কেন হবে? সিটি করপোরেশন ভাগ করা হলো—তা কি একজন মেয়রের জায়গায় দুজন মেয়র পাওয়ার জন্য? একটি নগর ভবনের বদলে দুটি নগর ভবন? দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অবস্থাও শোচনীয়। ২০৩টি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া ২ থেকে ৬৭ মাস পর্যন্ত। অথচ স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন নিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা বড় বড় কথা বলেন।

কোথাও যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, তা আবারও প্রমাণিত হলো কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতনে। শেয়ারবাজারের ধসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই নতুন উপসর্গ। এর আগে বোরো মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পাননি। সর্বত্র চলছে ফাউ খাওয়ার সংস্কৃতি। লুটপাট।

৩.

প্রথম আলোর মাধ্যমে দেশের মানুষ চাঞ্চল্যকর একটি খবর জেনেছে। আবু সাঈদ নামের এক কিশোরের বাবা জনৈক আজম ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। তাঁর দাবি, আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে এ রকম মামলা নতুন নয় বাংলাদেশে। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রুহুল আমিন কী করলেন? তিনি নাকি কোনো অন্যায় করেননি। আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। আর আসামিরা বলছেন, নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় তদন্ত হলে পুলিশ অপরাধীকে অনায়াসে নিরপরাধ এবং নিরপরাধকে অপরাধী বানাতে পারে। দেখা যাচ্ছে, জজ মিয়া নাটক এখনো মঞ্চস্থ হচ্ছে।

মাত্র দুই দিন আগে পুলিশ কনস্টেবল মামুন কালাম নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সাড়ে ১০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকালে জনগণ তাঁকে পিটুনি দিয়ে থানায় সোপর্দ করে। এর আগে মামুন ওই ব্যবসায়ীর কাছে অবৈধ মুদ্রা থাকার অভিযোগ এনে তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীর সন্দেহ হয়। তিনি ‘ডাকাত, ডাকাত’ বলে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে ওই পুলিশ সদস্যকে পিটুনি দিয়ে থানায় সোপর্দ করেন। মামুন বংশাল থানার কনস্টেবল কাম গাড়িচালক।

এক সপ্তাহ আগে যশোরের শার্শায় এক গৃহবধূ ধর্ষিত হন, সেই ঘটনায় এসআই খায়রুল আলম ও সোর্স কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল অভিযুক্ত। গত ২৫ আগস্ট ওই ভদ্রমহিলা আটক স্বামীকে উদ্ধার করতে থানায় গিয়েছিলেন। স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই খায়রুল আলম। টাকা না দেওয়ায় তাঁকে ৫০ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে চালান দেওয়া হয়। এরপর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২ আগস্ট সন্ধ্যায় বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনের এক কামরা থেকে পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ এক নারীকে আটক করেন রেলওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক লতিকা বিশ্বাস। রাতেই ওই নারীর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয় এবং পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়। রাতে থানার ভেতরেই ওই নারী ধর্ষিত হন।

৪.

পত্রিকায় পড়লাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির ১০টি গ্রুপ। এর মধ্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী ও চট্টগ্রামের মেয়রের একাধিক গ্রুপ আছে। এসব সংগঠনের স্বার্থে নয়, নেতার আধিপত্য রক্ষার জন্য কাজ করে। গ্রুপের মধ্যে যখন গ্রুপ তৈরি হয় তখন নেতার সংখ্যাও বেড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক ব্যানারের বাহার দেখলেই সেটি বোঝা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অনেক মেধাবী ছাত্রকে জীবন দিতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। কোনো হত্যার বিচার হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের নামে চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার নামে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ এসেছে। শিক্ষাঙ্গন হবে ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ’। সাম্প্রতিক কালে সেটি হয়ে পড়েছে ছাত্র নামধারী মাস্তানদের অভয়াশ্রম।

একটি দেশের অর্থনীতির শক্তিশালী উপাদান হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শেয়ারবাজার। বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশে এই দুটি খাত বিনিয়োগের উৎস। কিন্তু এই দুটি খাতই এখন নড়বড়ে অবস্থায়। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে। শেয়ারবাজারে ধস নামায় লাখ লাখ খুদে বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। নতুন অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ কমানোর ওয়াদা করে এখন বড় খেলাপি ও হল–মার্কের মতো জালিয়াতদের সুবিধা দিতে চাইছেন। এতে ব্যাংকিং খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ সুযোগটিও নষ্ট হতে পারে।

৫.

মানুষ আক্রান্ত হলে পুলিশের কাছে যায়। প্রতিকার চায়। কিন্তু সেই পুলিশ যখন নিজেরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। জাতির সংকটকালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে মানুষ সমাধান প্রত্যাশা করে। কিন্তু সেই নেতৃত্ব যদি পথভ্রষ্ট হয়, রাজনীতির ন্যূনতম নীতিও ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন পুরো জাতিই হতাশায় নিমজ্জিত হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে প্রশাসন জনপ্রতিনিধিদের কথা শোনে না। পুলিশ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপেক্ষা করে। কর্মীরা নেতাকে মানেন না। জেলা নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াক্কা করেন না। সাংসদ মন্ত্রীকে মানেন না। উপজেলা চেয়ারম্যান সাংসদকে উপেক্ষা করেন। সব খানেই চলছে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা এবং অক্ষমতা ঢাকার প্রাণান্তকর প্রয়াস। 

সোহরাব হাসান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি