অন্তত একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হোক

ডলার
ডলার

সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকা সফর সেরে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে সেখানকার প্রধান বাণিজ্য জোট মারকোসুরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (বিএফটিএ) করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য আগামী ডিসেম্বর মাসে জোটভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার প্রস্তাব দেবে। দক্ষিণ আমেরিকার চার দেশ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ে বর্তমানে এই জোটের সদস্য, যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্য জোট। ২০১২ সালে ভেনেজুয়েলা এই জোটের সদস্য হলেও ২০১৬ সাল থেকে তা আবার স্থগিত রয়েছে। আর বলিভিয়া যোগদানের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

এই জোটের আনুষ্ঠানিক নাম দক্ষিণের অভিন্ন বাজার (সাউদার্ন কমন মার্কেট), যার স্প্যানিশ সংক্ষিপ্তরূপ মারকোসুর। ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করা মারকোসুর এখন একটি শুল্কসংঘ। অর্থাৎ, জোটভুক্ত দেশগুলো বাইরে থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সমহারে শুল্কারোপ করে থাকে। বর্তমানে গড় শুল্কহার ১৪.০ শতাংশ। তবে পণ্যভেদে তা ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেমনটি বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ওপর প্রযোজ্য। বর্তমানে মারকোসুরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার আর বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তবে এই বাণিজ্যের প্রায় ৬৭ শতাংশই সেখানকার বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিলের সঙ্গে। দেশটি বর্তমানে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির নবম বৃহত্তম উৎস। তাই মারকোসুরের সঙ্গে বাণিজ্য মানে প্রধানত ব্রাজিলের সঙ্গে বাণিজ্য, যেমন দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য মানে প্রধানত ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য।

বাংলাদেশ যে দুই দশক ধরে বিভিন্ন বিএফটিএর চেষ্টা করছে, সেই প্রয়াসের ধারায় মারকোসুর সর্বশেষ সংযোজন। বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার বাড়ানোর জন্য এই প্রয়াসটা প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি এটাও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, কেন নানা ধরনের চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত একটিও বিএফটিএ করতে পারেনি। বস্তুত মারকোসুরের সঙ্গে তথা যেকোনো মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। প্রথমটি হলো, বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কতটা ব্যয়সাশ্রয়ী হবে ও বাড়বে; দ্বিতীয়টি হলো, অংশীদার দেশ বা জোট থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির ব্যয় কতটা কমবে। দুই ক্ষেত্রেই প্রথম নিয়ামক হলো দুই পক্ষের বিদ্যমান শুল্ককাঠামো। মারকোসুর শুল্কহার কতটা কমাবে, তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা। একইভাবে মারকোসুর থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুল্কহার কতটা কমাবে, তার ওপর নির্ভর করবে আমদানি সাশ্রয়ী হওয়া।

বিএফটিএ নিয়ে চিন্তা বা আলোচনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সাধারণভাবে একটু রক্ষণশীল হয়ে থাকে। তাই প্রাধান্য পায় প্রথম বিবেচনা বা রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়টি। সে তুলনায় দ্বিতীয় বিবেচনা বা আমদানির জন্য শুল্ক ছাড় দেওয়ায় একটু আপত্তি থাকে। এর জন্য দায়ী স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি ও আমদানি শুল্ক থেকে সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যেকোনো এক পক্ষের আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়টি। যে উৎসাহ বা আগ্রহ নিয়ে দুই দেশের সরকার কথাবার্তা শুরু করে, ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিবর্তনে তা অনেক সময় কমে যায়। ফলে আলোচনা কিছু দূর এগিয়ে গতি হারিয়ে যায় বা মাঝপথে থেমে যায়। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিএফটিএ করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরও তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া গেল না দুই বছরের বেশি সময় পরও। এভাবে আজ পর্যন্ত কোনো বিএফটিএ স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করা যায়নি, দর–কষাকষি বা সমঝোতা পুরোটা শেষ করার অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়নি।

অবশ্য দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা) চুক্তি ও এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তির (আপটা) মতো দুটি আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সমঝোতা সম্পন্ন করে তা বাস্তবায়ন শুরু করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে। তার মানে, মুক্তবাণিজ্যের জন্য দর–কষাকষির কলাকৌশল ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা-বোঝায় বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে, যা কিনা দ্বিপক্ষীয় দর–কষাকষিতে কাজে লাগবে, লাগছেও।

তবে সময় যত গড়াচ্ছে, মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ধারণা তত পরিবর্তিত ও বিস্তৃত হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে গতানুগতিক কাঠামোও। শুধু পণ্যভিত্তিক নয়, সেবা খাত সম্পৃক্ত করে বিএফটিএ এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হচ্ছে বিনিয়োগের বিষয়টি। এ তিনটি ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর আশায় গত বছর ভারতের সঙ্গে সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট বা সেপা) স্বাক্ষরে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। সেপাতে আরও রয়েছে মেধাস্বত্ব ও প্রতিযোগিতার মতো সংবেদনশীল বিষয়। অথচ একসময় ভারতের সঙ্গে বিএফটিএ করার কথা হয়েছিল।

আবার শুল্ক ছাপিয়ে বিভিন্ন অশুল্ক পদক্ষেপ নিয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হয় এখন। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশ যেভাবে পণ্যমানের শর্তারোপ করছে, তাতে রপ্তানিকারক দেশের পণ্য উৎপাদকদের আগের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে পণ্যমানের বিভিন্ন শর্ত একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

সর্বোপরি বাংলাদেশ আর স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে কোনো বিএফটিএর জন্য দর–কষাকষিতে সুবিধা করতে পারবে না। ২০২৪ সালে এলডিসির কাতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে, বিদ্যমান বাজারসুবিধাগুলোও ২০২৭-এর পর থেকে আর মিলবে না। এই বাস্তবতায় শুল্কছাড় ও বাজারসুবিধা আদায় করা স্বাভাবিকভাবেই কঠিন হবে। তাই এর আগে দৃষ্টান্ত ও অভিজ্ঞতা হিসেবে অন্তত একটা বিএফটিএ হওয়া বোধ হয় প্রয়োজন।

আসজাদুল কিবরিয়া : সাংবাদিক