অদম্য বার্নি বদলে দিচ্ছেন আমেরিকার রাজনীতি

বার্নি স্যান্ডার্স। রয়টার্স ফাইল ছবি
বার্নি স্যান্ডার্স। রয়টার্স ফাইল ছবি

বার্নি স্যান্ডার্সের জন্ম নিউইয়র্কে, ১৯৪১ সালে। কিন্তু তিনি বলে থাকেন, তাঁর রাজনীতির জন্ম ১৯৩২-এর জার্মানিতে। বিশেষ করে যখন ওই বছরের জুলাইয়ে হিটলারের সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি ভোটে জেতে। স্যান্ডার্সের মতে, ওই নির্বাচন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল, পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল, যার মধ্যে অর্ধ কোটি ইহুদিও ছিল।

নাজিদের কারণে পোল্যান্ড থেকে উৎখাত হওয়া ওই রকম এক ইহুদি পরিবারের সন্তান স্যান্ডার্স। জাতীয়তাবাদের ক্রুদ্ধ রূপ পারিবারিকভাবে তাঁর জানা। সেই থেকে বার্নি ওই রাজনীতির বিরুদ্ধে। ৭৮ বছর বয়সেও লড়াই থেকে থামার কথা ভাবছেন না, বরং আমেরিকার পুরো ‘স্ট্যাবলিশমেন্ট’-এর বিপরীতে নিঃসঙ্গ এক শেরপার মতো দাঁড়িয়ে আছেন।

আজীবন বার্নি যে বিপদের কথা বলছিলেন, সেটাই ফলতে চলেছে এখন দুনিয়াব্যাপী। করপোরেট ও জাতিবাদী রাজনীতির মেলবন্ধন সর্বগ্রাসী ঢেউ হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি আছড়ে পড়েছে সুদূর দক্ষিণ এশিয়াতেও, যার প্রধান শিকার নিচুতলার মানুষের রুটিরুজি, স্বাস্থ্যসেবা, স্বাধীনতা, এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিচয়ও।

যেভাবে মূলধারার রাজনীতিতে এলেন
ছাত্রজীবন থেকেই বার্নি রাজনীতিতে। শুরুতে নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামগুলোয় সময় দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে ভার্মন্টের বার্লিংটনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী রাজনীতিতে অভিষেক। ১৯৮৭ সালে তাঁকে আমেরিকার সবচেয়ে ভালো মেয়র বলা হতো। একপর্যায়ে বসবাসের জন্য সেরা শহরের মর্যাদা পায় বার্লিংটন।

১৯৯১ সালে তিনি দেশটির নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে জেতেন। ১৬ বছর এই দায়িত্বে থেকে ২০০৬ সালে সিনেটে সদস্য হয়ে আসেন। তিনবার পুনর্নির্বাচিত হন সেখানে। এরই ধারাবাহিকতা ২০১৬ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন চাওয়া। ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কৌশলগত। সবাই এখন জানে, বার্নির নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেয়েও সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

৯৯ শতাংশকে একত্র করতে চাইছেন
স্যান্ডার্সের নির্বাচনী ওয়েবসাইটে ঢুকলে একটা বাক্য চোখে পড়ে: ‘জয়ের একটা রাস্তাই কেবল খোলা আছে, তা হলো একত্র হওয়া’। স্যান্ডার্স আমেরিকার ৯৯ শতাংশকে একত্র হতে বলছেন। নিজে সে কাজেই শামিল। নিজেকে তিনি বলে থাকেন বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী। মধ্যবিত্ত ও উৎপাদক গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের বাড়তি ভূমিকা চান। কৃষক-শ্রমিকেরা দেশের সম্পদ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন—এই যুক্তিতে তাঁদের আয় বাড়ানোর কথা বলছেন জোরেশোরে। তাঁদের শোভন জীবনের নিশ্চয়তা দিতে অতি ধনী ১ শতাংশ থেকে কর আকারে বাড়তি অর্থ নিতে চান বার্নি।

রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে বার্নি স্যান্ডার্স বিশেষভাবে জোর দেন কর্মক্ষেত্রের গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর। ‘কর্মক্ষেত্রে গণতন্ত্র’-এর ধারণা সব প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্মকর্তা-কর্মচারী উদার অংশগ্রহণের কথা বলে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্যই নয়, উৎপাদন বাড়াতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এটা। প্রতিষ্ঠানগুলোয় গণতন্ত্রের চর্চা রাষ্ট্রের কেন্দ্রেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিক করে তোলে।

আমেরিকায় এ রকম বক্তব্য দেওয়া রাজনীতিবিদ বার্নিই প্রথম নন; তাঁর কৃতিত্ব হলো তিনি ওই রাজনৈতিক ভাবনাকে আলোচনার কেন্দ্রে আনতে পেরেছেন।

করপোরেটদের থেকে তহবিল নয়
হিলারি ক্লিনটনের কাছে হেরে ২০১৬ সালের নির্বাচনী দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন বার্নি। সে সময় অন্তত এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মনোনয়ন পাওয়ার জন্য নীতিগত বিষয়ে অন্তত একজন আপস করেন না। করপোরেটদের থেকে নির্বাচনী অর্থ নিতে রাজি নন বার্নি। এবারও স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান নিয়ে তাঁর তহবিল গড়ে উঠছে। ইতিমধ্যে ১০ লাখ মানুষ তাঁর তহবিলে অর্থ দিয়েছে। গড়ে প্রত্যেকের সহায়তার পরিমাণ ১৮ ডলার। তাঁকে অর্থ প্রেরণের ঠিকানার নিচে লিখে রাখা হয়েছে ‘নট দ্য বিলিয়নিয়ার্স’।

এ রকম একজনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রচারমাধ্যম সাহায্য করবে না, সেটা অস্বাভাবিক নয়। মূলত, ফেসবুক ও টুইটারকে ব্যবহার করে তিনি রাজনৈতিক প্রচার কাজ চালান।

২০১৬ সালে বার্নি যে রাজনৈতিক অবস্থানে ছিলেন, এবারও একই অবস্থান বজায় রেখেছেন। হিলারি তাঁকে প্রাইমারিতে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পেলেও গত চার বছর ডেমোক্র্যাট শিবিরে বার্নিকে নিয়েই বেশি আলাপ, আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে। বার্নি স্যান্ডার্স ও তাঁর সহযোগীরা অর্থনৈতিক অসাম্য, করপোরেটদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থার মতো লড়ে যাচ্ছেন। রিপাবলিকানদের দক্ষিণপন্থার সঙ্গে সংগ্রামের পাশাপাশি ডেমোক্রেটিক শিবিরেও অনুরূপ ধারাগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে তাঁকে। এই লড়াইয়েরই ফসল ঘণ্টায় ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলার নির্ধারণের সাম্প্রতিক ঘটনা। স্যান্ডার্সের বড় এক বিজয় এটা। ওবামার আমলেও ডেমোক্র্যাট শিবিরে দাবিটি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে সাত ডলার। স্যান্ডার্স প্রমাণ করলেন, নির্বাচনে না জিতেও রাজনীতিতে জেতা যায়।

তাঁর লড়াই দ্বিমুখী
গতবারের মতো এবারও স্যান্ডার্স ডেমোক্র্যাট শিবিরে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। মনোনয়ন নিয়ে যোসেফ বাইডেন, এলিজাবেথ ওয়ারেন এবং তাঁর মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মনে হচ্ছে। তবে শঙ্কা আছে, প্রাইমারির চূড়ান্ত অধ্যায়ে দ্বিতীয় স্থানে থেকেই তাঁকে বিদায় নিতে হতে পারে। ডেমোক্র্যাট অনেকে মনে করেন, যদিও স্যান্ডার্সের নীতিগত অবস্থান সমর্থনযোগ্য, কিন্ত তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হলে ট্রাম্পকে জয়ী হতে সহায়তা করা হবে। সমগ্র ক্ষমতাকাঠামো তখন সমাজতন্ত্রী স্যান্ডার্সকে ঠেকাতে পরোক্ষে ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে শুরু করবে। বার্নির বিশেষত্ব ঠিক এখানেই। তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এবং আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও।

পরপর দুই দফা প্রাইমারিতে স্যান্ডার্সের লড়াই আমেরিকাজুড়ে ডেমোক্র্যাট পার্টিকে কিছুটা বদলে দিয়েছে। আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতেও কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা। আট বছর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যুদ্ধ ব্যয়ের বিরুদ্ধে, করপোরেটদের লোভ ও মিথ্যার বিরুদ্ধে, সবার জন্য স্বাস্থ্য ও বিনা বেতনে শিক্ষাসুবিধা, ন্যায্য মজুরি ও জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বাড়তি বৈশ্বিক ভূমিকার পক্ষে বলে যাচ্ছেন তিনি। একদা কংগ্রেসে ইরাকে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন বার্নি। ২০১৮ সালের জুনে আমেরিকায় যে ১০ সিনেটর প্রতিরক্ষা বাজেট কমানোর পক্ষে অবস্থান নেন, তাঁদেরও নেতা বার্নি। এ রকম কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতি করা কঠিন। রিপাবলিকানরা তো বটেই, ডেমোক্র্যাট শিবিরেও তাঁকে নিয়ে অস্বস্তি আছে। কিন্তু বার্নি অদম্য। হয়তো ৮ সেপ্টেম্বর ৭৮তম জন্মবার্ষিকীও তিনি উদ্‌যাপন করবেন দেশটির কোনো শহরে তাঁর মতাদর্শ প্রচারে ব্যস্ত থেকে।

স্যান্ডার্সবাদের ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে এ মুহূর্তে হতাশা আছে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের জাতিবাদী রাজনীতির চূড়ান্ত জোয়ার দেখা যাচ্ছে সেখানে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের এজেন্ডাগুলো আমেরিকায় বিতর্কের কেন্দ্রে স্থাপন করতে পারা দেশটিতে গুণগত দিক থেকে একধাপ অগ্রগতি। ট্রাম্প যেভাবে রিপাবলিকান রাজনীতি কিছুটা বদলে দিয়েছেন, স্যান্ডার্সও ডেমোক্র্যাটদের রাজনীতি খানিক পাল্টে দিয়েছেন। এই মেরুকরণে কারা বিজয়ী হয়, সে বিষয়ে নজর রাখছে বিশ্বের সবাই। দুই দফায় নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে আমেরিকাজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ে এমন একদল রাজনীতিমনস্ক তরুণ-তরুণী তৈরি করেছেন বার্নি, যারা এখন তাঁর রাজনীতিকে বলছে ‘স্যান্ডার্সবাদ’। ডেমোক্র্যাট পার্টির ভেতরে ও বাইরেও রয়েছে স্যান্ডার্সবাদীরা। নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে সাংগঠনিক ভিত্তি দিতে ‘ব্র্যান্ড নিউ কংগ্রেস’ এবং ‘আওয়ার রেভল্যুশন’ নামে দুটো রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলেছে স্যান্ডার্সবাদীরা। এই লেখা তৈরির সময় ‘পিপল ফর বার্নি’ ফেসবুক পেজের সদস্য হয়ে আছেন ১৬ লাখ ৬৫ হাজার জন। স্যান্ডার্সের নির্বাচনী কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হতে নাম লিখিয়েছে ১০ লাখ তরুণ-তরুণী। এই স্যান্ডার্সবাদীদের ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের আমেরিকার নীতিগত রূপান্তর।

আমেরিকাকে ভেতর থেকে পাল্টানো বৈশ্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিবাদী ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের শক্তি ও মৈত্রীর এক বড় অনুপ্রেরণা আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা। এর পাশাপাশি আছে বৈশ্বিক দৈত্য করপোরেটদের একচেটিয়াত্বকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রশ্ন। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে স্যান্ডার্সরা। এই লড়াইয়ের ভবিষ্যতের মধ্যেই বার্নি বেঁচে থাকবেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট না হলেও।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক