রবার্ট মুগাবে: নায়ক ও ভিলেন

রবার্ট মুগাবে
রবার্ট মুগাবে

আপনি যদি কখনো সুযোগ পান, তবে দয়া করে জিম্বাবুয়ে সফর করবেন। এটি সংগীত ও ভুট্টার দেশ। সে দেশে যত দূর চোখ যায় খালি ভুট্টাখেত। কী অপরূপ তার সৌন্দর্য! এ দেশের মানুষগুলোর কথা কী বলব, তারা একই সঙ্গে কঠোর, ভদ্র ও দয়ালু।

আপনি যদি বৈপরীত্য পছন্দ করেন, তবে আপনাকে জিম্বাবুয়ে যেতে হবে। এবং আপনি যদি ধৈর্য কেমন, তা জানতে চান তবে আপনাকে সেখানে যেতে হবে। সেখানে যাওয়ার জন্য পরিবেশ বা প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক সাজুন বা যেকোনো অজুহাত খাড়া করুন এবং স্রেফ চলে যান। যাওয়ার জন্য খুব বেশি ভাববেন না।

হোটেলরুমে সকালে আপনার ঘুম ভাঙতে পারে গানের সুমধুর সুরে। হয়তো দেখবেন একদল শিল্পী আপনার হোটেলরুমের বাইরে গান গাইছেন। যেখানেই যান না কেন, দেখবেন সব খানেই প্রকৃতি কোনো না কোনো উপহার আপনাকে দিচ্ছে। আপনি যদি কোনো জিম্বাবুইয়ানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন, দেখবেন তাঁরা আগ বাড়িয়ে কিছু বলবেন না, আপনি তাঁদের কাছে শুনতে চাইলেই তাঁরা কেবল বলবেন।

 সুন্দর এই দেশটি গড়তে যে মানুষটি ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন, তিনি রবার্ট মুগাবে। আর যে মানুষটি সুন্দর এই দেশটি ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় ছিলেন, তিনিও রবার্ট মুগাবে।

আপনি কি জিম্বাবুয়ে সম্পর্কে জানতে চান? তাহলে আমাকে একটি গল্প বলতে দিন: যে লোকটি আমাকে হোটেল থেকে জোহানেসবার্গের বিমানবন্দরে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক। তিনি বলেছেন, কাজের ক্ষেত্রে জিম্বাবুয়ের মানুষের নৈতিকতায় পুরোপুরি মুগ্ধ। তাদের থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক কিছু শেখার আছে। আসলে আমাদের সবারই শেখার আছে।

আমার এ নিবন্ধ লেখার জন্য আমি আমার এক বন্ধুর সাহায্য চেয়েছি। আমি তাকে বলি, আমার প্রজন্মের একজন রবার্ট মুগাবে সম্পর্কে আসলে কী বলতে পারে? এবং আমার বন্ধু বলেছিল, রবার্ট মুগাবে এই দেশের ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন। এখন এ বিষয়টির ওপরই মনোযোগ দাও।

বন্ধুটি আমাকে আরও বলেছিল, যারা মৃতদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে ভয় পায়, আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারি না। মুগাবে এই পৃথিবীতে অনেক দুরাচার করেছেন এবং তার জন্য আমি তাঁকে হয়তো অন্তর থেকে সম্মান জানাতে পারব না। কিন্তু তিনি এমন কিছু করে গেছেন এবং রেখে গেছেন, যা অনেকের জীবনে অনেক কাজে আসবে।

আফ্রিকা থেকে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা দূর করতে মুগাবে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং এ জন্য তিনি পুরো আফ্রিকায় নায়কের সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু পরে সেই মুগাবেই পরিণত হয়েছিলেন স্বৈরশাসকে। বিরোধীদের দমন-পীড়নসহ ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে সমৃদ্ধিশালী জিম্বাবুয়েকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি।

আমরা সবাই চাই, আমাদের দেশনায়কেরা নির্দোষ হবেন এবং খলনায়কদের মধ্যে ভালো গুণাবলির ঘাটতি থাকবে। কিন্তু আপনি কি এমন কোনো দেশ ভ্রমণ করেছেন, যে কোনো কার্যকর কোনো মুদ্রা ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে চলেছে? হ্যাঁ, জিম্বাবুয়েতে ঠিক এ রকমটাই ঘটেছে। আর এ জন্য দায়ী করা হয় রবার্ট মুগাবেকে। প্রায় চার দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রবার্ট মুগাবেকেই জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক ধসের জন্য দোষারোপ করা হয়। জিম্বাবুয়েকে একসময় আফ্রিকার খাবারের ভান্ডার ধরা হতো। কিন্তু শিল্পকারখানার অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন খাতে মুগাবে সরকারের চরম দুর্নীতির কারণে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়ায় ওই অবস্থার পতন ঘটে। কৃষিজমিতে শ্বেতাঙ্গদের অধিকার বেআইনিভাবে খর্ব করার মধ্য দিয়ে জিম্বাবুয়ের বহুমাত্রিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ওই ঘটনার জেরে ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি এক-তৃতীয়াংশ সংকুচিত হয়ে যায়। বেকারত্বের হার ৮০ শতাংশের ওপরে উঠে যায়। লাখ লাখ মানুষ তখন দেশ ছেড়ে চলে যায়।

অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দ্রুত রাজনীতিতেও প্রবেশ করে। ফলে গোটা দেশ অস্থিতশীল হয়ে পড়ে। চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মুগাবেকে ক্ষমতাচ্যুত করে জিম্বাবুয়ের সেনাবাহিনী।

রবার্ট মুগাবে যখন ভালো ছিলেন, তো ভালো কাজ করেছেন এবং যখন তিনি খারাপ হন, তখন সত্যিই তিনি ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তাতে কি জিম্বাবুয়ের ভিত তৈরিতে তিনি যে সহায়তা করেছিলেন, তা মিথ্যা হয়ে যায়? তাঁর তৈরি করা ভিতটাও কি মিথ্যা হয়ে যায়? নিশ্চয়ই নয়।

আপনি যদি শিক্ষক না হতে পারেন, তবে শিক্ষা গ্রহণ করুন। রবার্ট মুগাবে একজন জটিল ও দুর্বোধ্য মানুষ ছিলেন, যে মানুষটির জন্য আমাদের মধ্যে অনেকেই আরও ভালো পরিণতি কামনা করত। কিন্তু আমরা অনেকেই তাঁর মৃত্যুতে অংশ নিয়েছিলাম। নিইনি কি আমরা?

আসুন, আমাদের নেতাদের আজীবন রাজা বানিয়ে তাঁদের ধূলিসাৎ করতে না শিখি। আসুন, আমরা দেশের জন্য তাঁরা যে ভিত্তি গড়ে তুলেছেন, তার প্রশংসা করি এবং সেই ভিত্তির ওপর আরও ভালো সরকার, আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলি। আসুন, আমরা আমাদের পুত্র এবং কন্যাদের রক্ষা করি, বিশেষ করে পুত্রদের রক্ষা করি; অহংবোধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করি। আসুন, আমরা তাদের পাপ ক্ষমা করার চেষ্টা করি।

আসুন, আমরা মুগাবেকে শান্তিতে থাকতে দিই। আংকেল বব তুমি যা করেছ, সেটাই ছিল তোমার জীবন।

বিদায় রবার্ট মুগাবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
এলসি ইয়াকুজ: তানজানিয়ার সাংবাদিক