নিয়ন্ত্রণহীন ব্যথার চিকিৎসা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এ দেশে ব্রেকবিহীন গাড়ির মতো ১৯৬০ সাল থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা। এখনো এই বিভাগ দেখার যেন কেউ নেই। অর্ধশতাব্দী পার হলেও ফিজিওথেরাপি কলেজ, কাউন্সিল ও পদ সৃষ্টি না হওয়ায় দেশের মানুষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যেই প্রতিবছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ফিজিওথেরাপিই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্রধান চিকিৎসা’।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী ব্যথার চিকিৎসায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রতি পাঁচজনের একজন দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ভুগছেন। আর এই রকম ব্যথায় আক্রান্ত ৪৯ শতাংশ মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ বাধ্য হয়ে কাজে অংশ নিতে হচ্ছে। ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক বড় একটি অংশ আংশিক বা পুরোপুরি প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ব্যথায় ভুক্তভোগীদের ৮০ শতাংশই সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসা মানেই ওষুধ নয়, আর ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক। যেমন ২০১৬ সালে শুধু আমেরিকাতে অতিরিক্ত ওষুধ সেবনে ৬৩ হাজার ৬৩২ জনের মৃত্যু হয় বলে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে। তাই দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাই উত্তম সমাধান এবং এ ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকেরাই প্রধান স্বাস্থ্য পেশাজীবী।

 বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় আক্রান্ত লাখ লাখ রোগী থাকলেও এদের সংখ্যা ও চিকিৎসা বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ফিজিওথেরাপি প্রধান চিকিৎসা হলেও বাংলাদেশে এই আধুনিক ও যুগোপযোগী চিকিৎসাপদ্ধতিকে অর্ধশতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠিত হতে না
দেওয়ার কারণে এ দেশে ব্যথার রোগীরা কষ্ট পাচ্ছেন। এ রকম পরিস্থিতিতেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) উদ্যোগে বাতব্যথা, প্যারালাইসিস ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা প্রতিকার ও প্রতিরোধে প্রধান চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতার লক্ষ্যে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, ফ্রি চিকিৎসাসহ সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর ২৬ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষ যতটুকু শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার, তা করেন না। এটা অনেক রোগের কারণ। পৃথিবীতে প্রতিবছর যত লোক মারা যায়, তাদের ৬ শতাংশ মারা যায় ফিজিক্যাল ইনঅ্যাক্টিভিটি থেকে সৃষ্ট নানা রোগব্যাধি ও শারীরিক সমস্যার কারণে। এই রোগগুলো ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি ও ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা বা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এ রকম পরিস্থিতিতে ফিজিওথেরাপির ব্যাপক প্রসার খুব জরুরি। মেডিকেল সায়েন্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হিসেবে ফিজিওথেরাপি এখন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাবিদ্যা হিসেবে অনেক জনপ্রিয়। ফিজিওথেরাপিতে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি আর ব্যায়াম ও অন্যান্য মাধ্যমে অনেক রোগ সারানো এবং সুস্থ ও সচল জীবনযাপনের সুযোগ আছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ নানা ধরনের প্রতিবন্ধিতায় ভুগছে। জনসংখ্যার ২০ ভাগের বয়স ৬০ বছরের ওপরে। তাঁরাসহ যাঁরাই বাতব্যথা, কোমর, মেরুদণ্ড ও ঘাড়ে ব্যথা, ক্রীড়াঘাত, পক্ষাঘাতগ্রস্ততা (প্যারালাইসিস), মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত (স্ট্রোক) সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের রোগের অন্যতম চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছে। তাদের জন্যও ফিজিওথেরাপি জরুরি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও কর্মক্ষম করা না গেলে দেশের টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) অর্জনে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পদক্ষেপের অভাবে কয়েক যুগেও দেশে কোনো ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠা, কাউন্সিল গঠন, পদমর্যাদাসহ কোনো পদ সৃষ্টি করা যায়নি। বছরের পর বছর সরকারের সব মহলে সব রকম চেষ্টা ও তদবির করেও কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিশ্চিত করতে মাননীয় সরকারপ্রধানের সুদৃষ্টি ও সরাসরি পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।

ডা. দলিলুর রহমান: বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি
manipsart@gmail. com