রাজধানীর বাসযোগ্যতা

গল্প, কবিতা, গানে ঢাকাকে যতই ‘প্রাণের শহর’, ‘জাদুর শহর’, ‘স্বপ্নের শহর’—ইত্যাকার বিশেষণে বিভূষিত করা হোক, আদতে বসবাসের দিক থেকে শহরটির অবস্থা শোচনীয় বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। আদর্শ বৈশ্বিক মানের নিরিখে এই শহরের যাতায়াত, পয়োনিষ্কাশন, আবাসন, জ্বালানি, পানিসহ প্রাত্যহিক জীবনঘনিষ্ঠ অতিপ্রয়োজনীয় খাতগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে বহু বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম সারিতে থাকছে।

যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বাণিজ্যবিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) গত বুধবার ২০১৯ সালের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা। বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান এখন ১৩৮তম। ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থা কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর সিরিয়ার দামেস্ক ও নাইজেরিয়ার লাগোস। গত বছরের তুলনায় ইআইইউ ইনডেক্সে ঢাকা এক ধাপ এগিয়েছে, এ নিয়ে অবশ্য আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারি। ‘গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স’–এ আগের বছর ঢাকা শহরের অবস্থান ছিল ১৩৯তম। আর এবার ১৩৮তম।

শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিপিইউ যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছে সেগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। লক্ষণীয় বিষয় হলো পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ঢাকা দুটি বিষয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তার একটি হলো ‘সংস্কৃতি ও পরিবেশ’ এবং অন্যটি হলো ‘অবকাঠামো’। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা যা রয়েছে সেগুলো হলো জলবায়ু ও তাপমাত্রা, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা, খেলাধুলার সুযোগ, খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও সেবা, সড়ক পরিবহনব্যবস্থা, গৃহায়ণ, জ্বালানি, পানি এবং টেলিযোগাযোগব্যবস্থা।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কেউ বা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি একটি করে বিশ্লেষণ করে, তাহলে যে একটি ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়।

এ কথা সত্য যে বসবাসের উপযোগী শহরের তালিকার প্রথম দিকে যেসব শহরের নাম এসেছে, সেই মেলবোর্ন, ভিয়েনা, ওসাকা বা ভ্যাঙ্কুভারের জনসংখ্যা ঢাকার তুলনায় খুবই কম। মেলবোর্ন বা ভিয়েনায় ঢাকার একটি অংশের লোক ঢুকিয়ে দিলে সেখানকারও সব ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু কথা হলো জনঘনত্বের এই বাস্তবিক অবস্থা মাথায় রেখেই ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করতে অনেক আগে থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। একটু সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে হয়তো এ শহরের বসবাসের মান উন্নত করা সম্ভব হতো।

এখন সরকার নানা অবকাঠামো তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ, সে তুলনায় এসব উদ্যোগ খুবই সামান্য। সবচেয়ে বড় কথা, এসব উন্নয়নকাজে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। ঢাকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেমন সমন্বয় নেই, তেমনি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও রয়েছে দক্ষতায় ঘাটতি। এর সঙ্গে দুর্নীতি যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলেছে। ঢাকার বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে শুরুতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে। রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

ঢাকার স্বার্থ রক্ষা করতে হলে শক্তিশালী একটি একক কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বিশেষজ্ঞ মহল থেকে অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। তেমন কিছু এখন করা না গেলেও একটি শক্তিশালী সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব বিভিন্ন সময়ে এসেছে। যেখানে সবগুলো প্রতিষ্ঠান মিলে সামগ্রিকভাবে ঢাকার দেখভাল ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে পারবে। কিন্তু এসব বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না।