বিমানবন্দরে বিদায় ও আবেগের দাপাদাপি

ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক (উড়োজাহাজের ফটকে) ঢাকায় ফেরার সময় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দরের রানওয়েতে প্রবেশ করেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।  ছবি: সংগৃহীত
ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক (উড়োজাহাজের ফটকে) ঢাকায় ফেরার সময় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দরের রানওয়েতে প্রবেশ করেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ছবি: সংগৃহীত

গরু–ছাগল খুঁটিতে যত সহজে ধরে বেঁধে রাখা যায়, আবেগ তত সহজে ধরে রাখা যায় না। আবেগ মারাত্মক জিনিস। সে নাবালকের মতো অবুঝ। পাগলের মতো উন্মত্ত। বিমার দালালের মতো নাছোড়। সে যুক্তিফুক্তি মানে না। আইনকানুন মানার তো প্রশ্নই ওঠে না।

বাঙালিকে আপ্লুত করতে আবেগের উপলক্ষ লাগে না। অজুহাত লাগে না। কাছের লোক কাছে এলে আবেগের উচ্ছ্বাস হয়। কাছের লোক চলে যাওয়ার সময় ৬ নম্বর বাসের বেগের চাইতেও বেশি বেগে সেই আবেগ চাগাড় দেয়।

সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেই ধরনের বাঁধনহারা আবেগের দাপাদাপি দেখা গেল। ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক সাংগঠনিক সফর শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন। কয়েক দিন বেড়ানোর পর চলে যাওয়ার সময় নতুন কুটুমকে পরিবারের সবাই মিলে যেভাবে খেয়াঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে, সেই তরিকায় কয়েক শ নেতা–কর্মী তাঁকে এগিয়ে দিতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। নেতার বিদায়মুহূর্তে তাঁরা ‘দিব না দিব না যেতে, ডাকিতে ডাকিতে’ একপর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। যেহেতু আবেগ আইন মানে না, সেহেতু ভিআইপি লাউঞ্জের মধ্যে ‘হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে’। সেলফি তুলতে কেউ আবার নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়িয়ে টারমাকে উড়োজাহাজের সিঁড়ির গোড়ায় চলে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা নেতাকে বিদায় জানাতে থাকেন ‘পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে’।

বিমানের দরজায় এমন কলকাকলির দৃশ্য এ দেশে এর আগে দেখা যায়নি। আগে দেখা যায়নি বলে এখন যাবে না—এই যুক্তি আলোচ্য ক্ষেত্রে খাটে না। এখানে ক্ষমতাকেন্দ্রিক আবেগের বিষয়। এখানে আইনকানুন, নিয়মনীতির ভাত নাই। আমরা এত দিন জেনে এসেছি, এমপি-মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ব্যক্তিরাই (সিআইপি) ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন। যাঁরা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতি পান, তাঁদের সঙ্গে দুজনের বেশি দর্শনার্থী যাতে না ঢোকেন, সে বিষয়ে তাঁদের অনুরোধও করা হয়।

জনপ্রতিনিধি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা সিআইপি না হয়েও ছাত্রলীগের সভাপতি ভিআইপি লাউঞ্জের সুবিধা পেয়েছেন। বিমানবন্দরের টারমাকে সংরক্ষিত এলাকায় ক্রু, যাত্রী ও অনুমোদিত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্যদের ঢোকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা সেখানে নেতাকে এগিয়ে দিতে গেছেন। এক ছাত্রলীগ কর্মী উড়োজাহাজের একেবারে সিঁড়ির গোড়ায় ফুলের তোড়াসহ দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছেন। সেখানে তোলা পাঁচটি ঐতিহাসিক ছবি ফেসবুকে তুলে ধরে একটি প্রামাণ্য স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সুলিখিত সেই স্ট্যাটাসে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মানিত সভাপতি শোভন ভাই চার দিনের সিলেট সফর শেষে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রার প্রাক্কালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভাইকে বিদায় জানাতে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের আগামী দিনের কান্ডারি, মুকুটহীন ছাত্রনেতা নাজমুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে।’ মাত্র একটি বাক্যের এই ‘সচিত্র প্রতিবেদন’ পত্রিকায় বিশেষ ট্রিটমেন্টে ছাপা হয়েছে।

এই অভূতপূর্ব ঘটনা সম্পর্কে সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ বাঁধিয়ে রাখার মতো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ সভাপতি লোকজন নিয়ে আসায় ভিআইপি লাউঞ্জের কোনো ক্ষতি হয়নি। পাশাপাশি তিনি দাবি করেছেন, কেউ বিমানের দরজা পর্যন্ত যাননি। বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তামান নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার মোক্ষম জবাব দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, এতে কোনো নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। ছাত্রলীগের সভাপতির মতো দেশের অন্য যেকোনো ছাত্রসংগঠনের সভাপতি যদি ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে চান, তাহলে তাঁকে সে সুবিধা দেওয়া হবে কি না, তা অবশ্য হাফিজ আহমদ সাহেব পরিষ্কার করেননি। ‘টারমাকে কেউ যায়নি’ বলে তিনি যে দাবি করেছেন, সেটিকে ঠিক বলে মেনে নিতে গেলে পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া খবর ও ছবিকে ডাহা মিথ্যা বলে মেনে নিতে হয়।

এখন কথা হলো, ছাত্রলীগের সভাপতিকে সাংগঠনিক প্রয়োজনে প্রায়ই বিমানে যাতায়াত করতে হয়। তাঁকে গ্রহণ করতে এবং বিদায় জানাতে নিচের সারির নেতা–কর্মীদেরও বিমানবন্দরে আসতে হয়। ভবিষ্যতে তাঁরা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করবেন না এবং টারমাকে ঢুকে পড়বেন না, এই গ্যারান্টিও নেই। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ‘না পারবে কইতে, না পারবে সইতে’। ফলে ছাত্রলীগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ—এই দুই পক্ষেরই ইজ্জত বাঁচানোর জন্য ছাত্রলীগ সভাপতিকে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। আর তিনি উড়োজাহাজে ওঠার সময় যাতে অনুসারীরা সুশৃঙ্খলভাবে সেলফি তুলতে পারেন, সে জন্য বিমানবন্দরের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে তৈলসিক্ত রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ করণিক পাণ্ডিত্যে যাঁরা নিজেদের নিমজ্জিত রাখার বিদ্যা আত্মস্থ করতে আগ্রহী, তাঁদের পর্যাপ্ত পুষ্পমাল্য ও সেলফি তোলার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা যেতে পারে।

এর বাইরে যা করা যেতে পারে তার জন্য অবশ্য মেরুদণ্ড থাকা প্রয়োজন। উপযুক্ত প্রশাসনিক দৃঢ়তার অভাবেই যেহেতু এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন আত্মসংশোধনকেই একমাত্র সম্ভাব্য পথ হিসেবে বেছে নিতে হবে। প্রশাসন কিছুই করবে না, এই সর্বজনীন বিশ্বাসটি না ভাঙতে পারলে পরিত্রাণের পথ নাই—এই কথা বিশ্বাসের মধ্যে আনতে হবে।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]