ভাবিয়া করিও কাজ...

দেশের নির্বাচনে বিশাল অংশের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া নিয়ে নানা উদ্বেগ আর উত্তেজনা, যার আঁচ দূর প্রবাসেও লেগেছে। কিছু হলেই সরকারের হাত আছে, এমন বলার যেমন লোক আছেন, তেমনি যাঁরা প্রার্থী তাঁদের রাজনৈতিক অপ্রস্তুতি নিয়েও নানা কথায় সুদূর এই সরগরম। 

পশ্চিমের দেশে কেউ ঘুম থেকে উঠেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে না। বাবা মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন না, ‘ওঠো আজ তোমার বিয়ে।’ তেমনি রাজনীতিতেও কেউ হুট করে নেমে পড়েন না। সবকিছুরই একটা প্রস্তুতি থাকে এখানে। থাকে নিজের মানসিক প্রস্তুতি। থাকে সব ধরনের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখা যায় পাসপোর্টই আনা হয়নি। তেমনি জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাতিলের অনেক কারণের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলো শুধু আমাদের দেশের শোনা সম্ভব। আমেরিকার একদম স্থানীয় নির্বাচনেও যিনি নির্বাচন করবেন বলে স্থির করেন, তাঁরও একটা প্রস্তুতি থাকে। এ প্রস্তুতি দালালি বা চামচামির নয়। এ প্রস্তুতি ধরাধরিরও নয়। প্রস্তুতি থাকে সার্বিক। পরিবার প্রস্তুত থাকে প্রার্থীকে সাহায্য করার জন্য। প্রার্থীর মনোনয়নপত্র থেকে প্রাক-নির্বাচনী বিষয় দেখার জন্য আলাদা টিম থাকে। এ টিমে অ্যাটর্নি রাখা হয় একাধিক। আইন পেশার লোকই আইনের ফাঁকফোকর আগে থেকে দেখে নেন। আমাদের মতো পৃথিবীর আর কোথাও মুহুরি দিয়ে দলিল লেখানো বা ফরম পূরণ করা হয় কি না, জানি না। এসব দেখেন আইন পেশার লোকেরাই। এর ফলে আইনের জটিলতায় পড়ার আগেই সব ঠিকঠাক থাকে। পরে ষড়যন্ত্র, প্রভাব কিছুরই পাল্লায় পড়তে হয় না। আইনের দেশ, আইন-মানা সমাজ একদিনে গড়ে ওঠে না। এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা লাগে। লাগে উদার হওয়া।

আমাদের এক প্রার্থী হলফনামায় সই করতে ভুলে গেছেন। হলফনামা যদি নির্বাচনী আইনে বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে, তাহলে সই ছাড়া এটা দেওয়ার সুযোগ নেই। নির্বাচনী কর্মকর্তা কী করবেন? শতভাগ আইনসিদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে যদি কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল হয়, সে ভিন্ন কথা।

আরেকজন বলেছেন, ক্রেডিট কার্ডের ফি বাকি থাকায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। সমর্থকেরা বলছেন, এসব মামুলি ব্যাপার! না, আইনে মামুলি ব্যাপার বলে এসব এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। আমেরিকায় সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা নিজেই গাড়ি চালান। রেড লাইটে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার কারণে জরিমানা দিতে হয়। না দিলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। সামান্য জরিমানায় তাঁদের মাফ পাওয়ার সুযোগ নেই। গ্রেপ্তারের এমন ঘটনা ব্যতিক্রম কিছু নয়। এখানে ডেমোক্র্যাট দলীয় কেউ সাজা পেলে ট্রাম্পকে দোষ দেওয়ার অবকাশ নেই। ক্রেডিট কার্ডের ১৯ ডলার বাকি আছে তো ব্যাড ক্রেডিট হয়ে গেছে মেয়াদের পর। আইনে যদি বেড ক্রেডিটওয়ালাকে নির্বাচনের অযোগ্য করার কথা থাকে, সেখানে কার কী বলার আছে।

ঋণখেলাপি মানে এসব লোকের কোনো ক্রেডিট অবশিষ্ট নেই। যে ব্যক্তি তাঁর ব্যবসা বা গৃহনির্মাণের জন্য ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করেননি, তিনি ব্যাংকের সঙ্গে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। তার আবার জনপ্রতিনিধি হওয়ার শখ কেন? এ লোক তো আগেই অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য চিহ্নিত। মনোনয়নপত্র তো তাঁর বাতিল হওয়ারই কথা। এমন লোক নির্বাচনের জন্য দাঁড়ান কেন?

কোনো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। এমন মনোনয়নের জন্য একটা নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটারের স্বাক্ষর লাগে। তাঁদের নাম-পরিচয় চিহ্নিত করেই কাগজপত্র জমা দিতে হবে। তা করা হয়নি। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া স্বাক্ষরের সঙ্গে প্রকৃত লোকের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন হা-পিত্যেশ করে কী হবে?

আরেকজন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন—একই আবেদনে তাঁর স্বাক্ষর দুই রকমের । যে নিজের নামটা একভাবে লেখতে পারেন না, জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে আরও কিছু কাজ করে আসার কথা জনগণ তাঁকে বলতেই পারে।

আরেক প্রার্থী হলফনামা দিয়েছেন, বিবরণী দিতে ভুলে গেছেন। একজন বিবরণী দিয়েছেন, নোটারি করতে ভুলে গেছেন বা সময় পাননি। এসব খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে আমাদের রাজনীতিতে অনেকেরই কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। মনোনয়ন দেওয়ার দিন পর্যন্ত অনেকেই জানেন না, তিনি প্রার্থী হচ্ছেন কি না। এ এক চরম অব্যবস্থা। আমাদের রাজনীতিও যে পেশাদারির কাছাকাছি পৌঁছায়নি, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? একজন মানুষের কোনো প্রস্তুতি নেই, তিনি জনপ্রতিনিধি হবেন! তা-ও জাতীয় সংসদের। সেখানে তিনি দেশের মানুষের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন!

যিনি সারা বছর বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকলেন, তিনি নির্বাচনের সময় দেশে গিয়ে প্রার্থী হয়ে গেলেন। জনগণের সঙ্গে তাঁর তেমন যোগাযোগ নেই, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। দল চাইলেই হতে পারে।

এমন অপ্রস্তুতি আর কতকাল চলবে? শুরুটাই যদি এমন অপ্রস্তুতি দিয়ে হয়, তাহলে নির্বাচিত হলে মানুষ তাঁদের কাছে কী আশা করবে? উন্নয়ন তো খালি সড়ক আর বিদ্যুৎ নয়, উন্নয়ন মানে একটা সামগ্রিক অবস্থা। এ সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নিজের মধ্যেও সমগ্রতা থাকা দরকার। নিজের অক্ষমতা, অদক্ষতা, অপারগতার দায় অন্যদের ওপর চাপিয়ে পালানোর পথ পাওয়া যাবে, সমগ্রতার মধ্যে আর স্থান পাওয়া যাবে না।

ইব্রাহীম চৌধুরী: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।
[email protected]