উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কে?

কিম জং-উন। ছবি: রয়টার্স
কিম জং-উন। ছবি: রয়টার্স

উত্তর কোরিয়ার সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে আমাদের মনে এই প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে উত্তর কোরিয়ার ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ কে? এটা কি কিম জং-উন? নাকি সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেম্বলির প্রেসিডিয়াম প্রধান চো রিয়ং হায়ে? আমি এখানে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে আমি পাঠকদের সচেতন করে দিতে চাই যে কলামটি মূলত একটি পাঠ অনুশীলন। কারণ, কিম জং-উন সংবিধান সংশোধনীর আগে ও পরে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করছেন এবং ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তখন উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। গত জুলাই মাসে উত্তর কোরিয়ার নতুন সংবিধান প্রকাশ করা হয়। এই সংবিধানে ২০১৬ সালে গঠিত শীর্ষ পরিচালনা পর্ষদ ‘স্টেট অ্যাফেয়ার্স কমিশন’ (এসএসি)-এর চেয়ারম্যান কিম জং-উনকে ‘কোরিয়ার জনগণের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি’ এবং ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ বলা হয়েছে। সর্বোচ্চ প্রতিনিধি মানে কি রাষ্ট্রপ্রধান? এই বিতর্কের সূত্রপাত আসলে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’-এর অর্থ কী তা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝির কারণে। রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র আজকাল বিরল এবং সংসদীয় প্রজাতন্ত্র বা একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে সাধারণত দুটি শীর্ষ পদ থাকে: প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশ পরিচালনা করেন এবং রাষ্ট্রপতি/ রাজা/ গভর্নর বা জেনারেল, যিনি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ থাকেন। তবে কিছু চরম ক্ষেত্রে জাতীয় প্রশাসনে তাঁরা হস্তক্ষেপ করেন। শেষোক্ত পদাধিকারী ব্যক্তিদের সাধারণত ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফলে একটি স্বাভাবিক ধারণা তৈরি হয়েছিল যে এসপিএ প্রেসিডিয়ামের প্রধান হচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার ‘রাষ্ট্রপ্রধান’। রাষ্ট্রপ্রধান বা এ ধরনের ক্ষমতাহীন ব্যক্তিরা সাধারণত তাঁর দেশে সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের সাক্ষাৎ দেন। এবং তাঁকে নিউজিল্যান্ডের গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে খুব আলাদা বলে মনে হয় না। 

তাহলে কিম জং-উনের অবস্থান কী? সংবিধান সংশোধনীর পর কোনো পরিবর্তন কি এসেছে? এটা বোঝার জন্য আসুন আমরা উত্তর কোরিয়া বা ডিপিআরকে এর সাংবিধানিক ইতিহাসটি একবার বিবেচনায় নিই। যখন ডিপিআরকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন কিম ইল-সুংয়ের রাষ্ট্রীয় অবস্থান ছিল প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৪৮ সালের সংবিধান অনুসারে, ‘প্রধানমন্ত্রী ডিপিআরকে সরকারের প্রধান।’ তবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়নি যে কে হবেন রাষ্ট্রপ্রধান, যা স্বাভাবিকভাবেই এই ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে এসপিএ প্রেসিডিয়ামের প্রধান হবেন রাষ্ট্রপ্রধান। মহান নেতার অহংবোধ থেকে কিম ইল-সুং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বিষয়টি নির্দিষ্ট করা দরকার। 

১৯৬৮ সালের ১ জুন রোডং সিনমুন–এ প্রকাশিত কঙ্গো-ব্রাজাভিলের জনগণের স্বাক্ষরিত একটি বার্তায় তাঁকে প্রথমে বিদেশিরা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর আরও বহুবার কিম ইল-সুংকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে ডিপিআরকে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যাতে সরাসরি বলা হয়েছিল যে ডিপিআরকের প্রেসিডেন্ট সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিনিধিত্ব করবেন। সংবিধানের এই ধারা ১৯৯২ সালের সংশোধিত সংবিধানেও রাখা হয়েছিল। কিন্তু এর ঠিক দুই বছর পর কিম ইল-সুং মারা যান। 

কেবল ১৭৭২ ও ১৯৯২ সালের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ক্ষমতাসীন কিম-ডিপিআরকের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের প্রধান কিম ইল-সুংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে কিম জং-ইল তাঁর বাবার মতো কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি কেবল জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিশনের (এনডিসি) চেয়ারম্যান এবং পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডারের পদটি ধরে রেখেছিলেন। কিম জং-ইল প্রেসিডেন্ট ছিলেন না এবং রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন না। ভাইস প্রেসিডেন্টের কোনো পদও তিনি রাখেননি। ১৯৯৮ সালে নতুন সংবিধানে বলা হয়েছিল যে ‘এনডিসি হলো সামরিক দিকনির্দেশনার সর্বোচ্চ অঙ্গ এবং সেই অঙ্গ, যা জাতীয় প্রতিরক্ষা পুরোপুরি পরিচালনা করে ও ডিপিআরকে চেয়ারম্যানের এনডিসি সশস্ত্র বাহিনীর পুরোপুরি নেতৃত্ব দেয় এবং জাতির প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে।’ কিম ইল-সুংকে চিরন্তন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করার সময় এসব পদ সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের সংবিধানেও রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন, তা নির্ধারণ করা হয়নি। কেবল ২০০৯ সালে সংবিধানে বলা হয়েছিল যে ‘ডিপিআরকে চেয়ারম্যানের এনডিসি হলেন ডিপিআরকের সর্বোচ্চ নেতা।’ উল্লেখযোগ্য যে এখানেও ‘রাষ্ট্রপ্রধানের’ পদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। 

সংক্ষেপে: কেবল ১৯৭২ ও ১৯৯২ সালে সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ক্ষমতাসীন কিমের রাষ্ট্রীয় অবস্থান হচ্ছে তিনি ডিপিআরকের প্রেসিডেন্ট। এটি ২০০৯ সাল থেকে এই পদকে ‘সর্বোচ্চ নেতা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। যাহোক, সংবিধান কখনো অন্য কাউকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেনি এবং এর সব উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় সব সময় বর্তমান কিমের জন্য নিবেদিত হয়ে আসছে। ডিপিআরকেতে সব সাংবিধানিক সংশোধনকে খুব অর্থবহ হিসেবে দেখার একটি অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা রয়েছে। প্রকৃত কথাটি হচ্ছে এই সংশোধনীগুলো বেশির ভাগ অর্থহীন। 

নর্থ কোরিয়া নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ফিওদর টার্টিটস্কি উত্তর কোরিয়ার রাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ