নিরাপদ সড়ক ও মহাসড়ক

প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন যে দেশে সড়কে প্রাণ হারায়, সেই দেশে দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির বা সড়ক পরিবহন খাতের হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি বন্ধ করার কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের নেই। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের সংশোধনীতে ক্লেইম ট্রাইব্যুনালের দ্বারা হতাহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান বিলোপ করা হয়। ক্ষতিপূরণ ধার্যে করা হয় ট্রাস্ট, যা গঠনের লক্ষণ নেই। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বহুসংখ্যক কমিটি এবং তার শত শত সুপারিশ মাথায় নিয়ে সরকার এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের মধ্যে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এটা শেষ পর্যন্ত একটি লোকদেখানো উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

সড়ক দুর্ঘটনাকে কেবলই বিচ্ছিন্নভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে দেখার বাতিক নীতিনির্ধারকদের পরিহার করতে হবে। সড়কের মতো আরও অনেক সরকারি সেবা খাত রয়েছে, যার সুষ্ঠু ও টেকসই ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। যেমন যদি রাজধানী ঢাকার বিষয়টি
বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলে বলতে হয় সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নগর সরকার বা এ ধরনের কোনো কর্তৃপক্ষ গঠনের বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। এ ধরনের কর্তৃপক্ষ গঠন করে এর আওতায় ঢাকার সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে আসা গেলে রাজধানীর পরিস্থিতিতে বদল আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের কমিটিও নতুন করে ১১১টি সুপারিশ পেশ করেছে। অথচ সুপারিশের কোনো কমতি কখনো ছিল না। কমিটির পরিবর্তে শক্তিশালী টাস্কফোর্স করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে কমিটি গঠনে উপযুক্ত লোক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেই মূল ঘাটতি ছিল। কিংবা সুপারিশ দেওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের কমিটিগুলো দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিল। বরং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে কী করতে হবে বা কোথায় গলদ, তা বহু আগে থেকে চিহ্নিত। দেশের পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা এসব বিষয় নিয়ে নিচ থেকে সর্বোচ্চ মহলের কাছে কী করণীয়, বিশ্বাসযোগ্যভাবে তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ-সংক্রান্ত পুরোনো নথিপত্রই তা সাক্ষ্য দেবে। 

বিআরটিএর মতো প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও লোকবল বছরের পর বছর সন্তোষজনক পর্যায় থেকে বহু দূরে রয়েছে। অমনোযোগী পথচারীর তুলনায় অদক্ষ চালকদের কারণেই যে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ এই ক্ষেত্রে লোকবল বাড়ানো, অবকাঠামো তৈরি এবং আধুনিক প্রশিক্ষণ স্কুল বা ইনস্টিটিউট তৈরি করা হচ্ছে—এমন কোনো উদ্যোগ বা প্রতিশ্রুতি সরকারের তরফে নেই। বিআরটিএর সামর্থ্য বাড়ানো, একে দুর্নীতিমুক্ত করা বা প্রতিষ্ঠানটিতে দক্ষ পরিদর্শক বাড়ানোর জোরালো ও কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব কি? কিন্তু এসব মৌলিক কাজ অসম্পন্ন রেখে কিছুদিন পরপর কমিটি বা টাস্কফোর্স গঠন করে মানুষের নজর আড়াল করে রাখার একটা অব্যাহত কসরত আমরা অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করছি। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো অত্যন্ত দায়িত্বশীল মন্ত্রীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদারকি ও জাতীয় নিরাপত্তাগত বিষয়ে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দিতে হয়। সড়কে যেখানে পদ্ধতিগত নৈরাজ্য চলছে, সেখানে এ ধরনের টাস্কফোর্স, যার বেশির ভাগ্য সদস্য অন্যান্য ডিসিপ্লিনের লোক, তাঁদের অনেকেই দেখা যাবে একটি সভায় আসবেন তো তিনটিতে গরহাজির থাকবেন। নিয়মিত সভা হবে কি না, সেই সন্দেহও রয়েছে। সদস্যদের কেউ কেউ আন্তরিকভাবে চাইলেও সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা কমাতে এই টাস্কফোর্স কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে, সে আশা করা যাচ্ছে না। আশা করার কোনো কারণও নেই।