সরকারি তদন্ত কমিটি ও জনগণের নিয়তি

কর্মজীবনে কে কখন কোন পদে দায়িত্ব পালন করেন, সেটা এক কথা। পদাধিকারীর প্রধান পরিচয়, তিনি একজন মানুষ। একজন সুস্থ ব্যক্তি বা মানুষ একটি উদ্ভিদ বা অন্য কোনো প্রাণীর মতো জীবন্ত সত্তা নয়। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ শুধু যে তার বুদ্ধি, তা নয়, তার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ তার বিবেক।

একজন দাস তার প্রভুর অনৈতিক আদেশ পালন করতে বাধ্য হয়। দাস পরাধীন হলেও তার বিবেক তাকে দংশন করে। সে দংশনে তার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। সে রক্তক্ষরণের অব্যক্ত যন্ত্রণা বাধ্য হয়ে তাকে সইতে হয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা দাসের মতো পরাধীন নন, আইনগত কিছু বাধ্যবাধকতা থাকলেও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করায় তাঁর কোনো বাধা নেই। কোনো অসামরিক সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হলে তাঁকে ‘বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত’ করা যায়। তবে ‘তাঁহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসংগত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাঁহাকে বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান, নবম ভাগ, ১৩৫ ধারা)

কোনো সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা অথবা কোনো অন্যায় কাজে যুক্ত থাকার জন্য তিনি অভিযুক্ত হলে তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে। তদন্ত কমিটির কাজ প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া। তারপর বিভাগীয় মামলা হতে পারে। বিচারে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বনিম্ন শাস্তি তিরস্কার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুতি। অভিযুক্ত যদি মনে করেন তিনি ন্যায়বিচার পাননি, তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারেন। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগ বিনা বিচারে ধামাচাপা দেওয়া অত্যন্ত অন্যায়। আমাদের রাষ্ট্রে প্রশাসনের অসামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত প্রশাসনের তাঁদের সহকর্মীরাই করেন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের কর্মকর্তাদের ওপর বর্তানো হয়। ফলে সেগুলোর তদন্ত প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন থাকে।

সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর কোনো সময়ই মানুষের আস্থা ছিল না, সে জন্য দাবি করা হতো বিচার বিভাগীয় তদন্তের। এখন তার ওপরও মানুষের আস্থা নেই। আস্থা না থাকার সংগত কারণ রয়েছে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন বিচারপতিকে। তিনি যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমি আমার এই কলামে লিখেছিলাম, ওই তদন্ত প্রতিবেদন নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্যোপন্যাসের কাহিনিকে হার মানিয়েছে। বাংলাদেশের তদন্ত কমিটির ইতিহাসে আবেদীনীয় সেই প্রতিবেদন একটি কালো দলিল হয়ে রয়েছে।

১৯১৯ সালে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের রাজনীতিতে যোগ করে নতুন মাত্রা। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের তদন্তে লর্ড হান্টারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কোনো প্রতিনিধি গ্রহণ করতে সরকার অস্বীকার করে। তাতে ভারতীয় সদস্য ছিলেন স্যার চিমনলাল শীতলবাদ, পণ্ডিত জগৎ নারায়ণ এবং সাহেবজাদা সুলতান আহমদ খান। স্যার চিমনলাল তাঁর রিকালেকশনস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস বইয়ে লিখেছেন, কমিটির চেয়ারম্যান হান্টার ছিলেন একজন দাম্ভিক ও বদমেজাজি। একদিন চটে গিয়ে বলেন, ‘আপনারা ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়াতে চান।’ সেকালের মানুষের মেরুদণ্ড ছিল। চিমনলাল জবাবে বলেছিলেন, ‘বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতীয়দের যে আকাঙ্ক্ষা, তা বৈধ। পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ সম্ভব, কিন্তু ব্রিটিশরাজ যদি আপনার ও ডায়ারের মতো অসহিষ্ণু ও অদূরদর্শী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি করে পাঠান, তখন তাঁদের তাড়াতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে মানুষ বাধ্য হবে।’ এরপর তিন ভারতীয় সদস্য হান্টারের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। অন্যদিকে বেসরকারি তদন্তের সঙ্গে বাংলা থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ এবং এ কে ফজলুল হকও যুক্ত ছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ তদন্তের সময় থেকেই উপমহাদেশের রাজনীতিতে গান্ধী ও জিন্নাহ পাদপ্রদীপের আলোতে আসেন। 

আর একটি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তদন্তে বিচারপতি এলিসকে দিয়ে যে প্রতিবেদন করানো হয়, সেটি ছাত্রসমাজ ও রাজনীতিবিদেরা প্রত্যাখ্যান করেন। উপসংহারে তিনি বলেছিলেন, ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো অপরিহার্য ছিল, পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি করেছে। ওই প্রতিবেদনের জন্য এলিস আজও বাঙালিদের কাছে নিন্দিত।

জালিয়ানওয়ালাবাগ, একুশে ফেব্রুয়ারি ও একুশে আগস্টের ঘটনা খুব বড় ব্যাপার। ছোট, মাঝারি আরও বহু ব্যাপারে গত ১০০ বছরে অসংখ্য তদন্ত কমিটি হয়েছে। সব কটিই যে পক্ষপাতদুষ্ট, তা নিশ্চয়ই নয়। ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তা আমাদের প্রশাসনে আছেন। কিন্তু অধিকাংশ নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ফাইলবন্দী করে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য বিব্রতকর কিছু থাকলে সে প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না।

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ১ লাখ ৪৩ হাজার টন কয়লা, লোকে বলে চুরি হয়েছে, সরকারি তদন্ত প্রতিবেদন বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বা সিস্টেম লস হয়েছে। হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া কয়লার পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলেই নাগরিকদের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সরকারের কিছুমাত্র ক্ষতি তো হতোই না, বরং ভাবমূর্তি ভালো হতো।

তদন্ত কমিটি সম্পর্কে কিসসা শেষ করি সর্বশেষ একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দিয়ে। গত ৩১ জুলাই মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে একজন ‘ভিআইপি’র জন্য ফেরি তিন ঘণ্টা দেরি করে। সেখানে অ্যাম্বুলেন্সে থাকা মুমূর্ষু কিশোর তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয়। ঘটনাটি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও বেদনার সৃষ্টি করে। 

সরকার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে উপস্থাপনের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসকের কোনো দায় খুঁজে পায়নি। সব দায় গিয়ে পড়েছে ফেরিঘাটের তিন হতভাগ্য কর্মচারীর ঘাড়ে। তাঁরা হলেন ঘাটের ব্যবস্থাপক, ঘাটের প্রান্তিক সহকারী ও একজন উচ্চমান সহকারী। প্রতিবেদনের ভাষ্য: ফেরি দেরিতে ছাড়ায় তিতাসের মৃত্যুর দায় এই তিনজন এড়াতে পারেন না। ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে পড়ে, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর।’ আমাদের রাষ্ট্র সবচেয়ে দুর্বলকে দোষী সাব্যস্ত করতে দক্ষতার পরিচয় দেয়। 

সত্য প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা থেকেই একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন। সেই লাখ লাখের মধ্যে খুব সামান্যই ছিলেন পদস্থ কর্মকর্তা, ৯৯ দশমিক ৯ ভাগই সাধারণ মানুষ। আজ সেই ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ দেখছে, রাষ্ট্র দুর্বলদের বিরোধী এবং ক্ষমতাবানদের বন্ধু। তাদের জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক