বাংলাদেশ থেকে ভারতের যা শেখার আছে

ভারতের অর্থনীতি নিয়ে একের পর এক যেসব দুঃসংবাদ আসছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে জানলাম, বিশ্বের পোশাক রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যেসব কোম্পানি চীনা শ্রমিকদের দিয়ে পোশাক তৈরি করাকে বেশি খরচসাপেক্ষ মনে করছে, তারা এখন চীন ছেড়ে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের দিকে চলে আসছে। এর মধ্য দিয়ে আরও একবার দেখা যাচ্ছে স্বল্প খরচে পণ্য উৎপাদন খাতে শ্রমভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় ভারত অনেকটাই পিছিয়ে আছে। 

স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, রপ্তানি খাতে দেশটির সাফল্য উল্লেখ করার মতো। অনেকের মতে, এই সাফল্য অলৌকিক ঘটনার মতো। অনেক খাতেই দেশটির অনেক অর্জন ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে সফলভাবে পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক একটি কার্যক্রম চলছে। লিঙ্গসমতার দিক থেকেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। 

সত্তরের দশকে আমি নিয়মিত বাংলাদেশে যেতাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় নদীমাতৃক দেশটির অধিকাংশ সেতু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পারাপারে ব্যবহার্য বেশির ভাগ নৌযান ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের শোষক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেনাসদস্যদের মধ্যে যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন, তাঁরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন এবং যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন, তাঁরা সেখানে আটকা পড়েন। যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল এবং এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে দেশটি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ওই দুর্ভিক্ষে সরকারি হিসাবে ২৭ হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যায়। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। এরপর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ নিহত হওয়ার পর দেশটিতে পরপর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান হয় এবং দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যায়। 

এই বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশে দুটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশের জন্মের প্রথম বছরেই ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, জীবিকা এবং দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি শিক্ষা দিতে এই এনজিওটির জন্ম। বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্র্যাক প্রধান ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্র্যাক কাজ করছে। ৬৬ হাজার স্কুলের মাধ্যমে ব্র্যাক ১৮ লাখ শিশুকে শিক্ষা দিচ্ছে। এ ছাড়া ১৯৭৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশটিতে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক, যেটি নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক একটি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের শুরু হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। 

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, ১৯৯০ সালে আর্থিক দেউলিয়াত্বের একেবারে প্রান্তে চলে যাওয়ার ফলে দেশটির একদিক থেকে লাভই হয়েছিল, কারণ এই সংকট তাঁকে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওকে অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে বিরোধীদের বাধা সামলাতে সহযোগিতা করেছিল। 

আমার মনে হয় বাংলাদেশও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশকে আগে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, এই সহায়তার সঙ্গে আসা বিদেশি পরামর্শকেও তার গ্রহণ করতে হয়েছে। দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক সব সময়ই যে সুখের ছিল, তা নয়। বাংলাদেশিরা দাবি করে থাকে (কিছু ক্ষেত্রে সেই দাবির ন্যায্যতাও আছে) তাঁদের দেশের জন্য কোনটি ভালো, তা তাঁরা বোঝেন। এমন অভিযোগও আছে, কিছু দাতা দেশ বাংলাদেশের স্বার্থের চেয়ে তাদের নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশকে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের বিদেশি সহায়তানির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিকদের পক্ষে আর্থিক সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকীকরণ বা নিজেদের স্বার্থে সেসব সহায়তার অর্থ ব্যবহারের সুযোগ অনেক কম। বাংলাদেশ সরকার দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে এনজিওগুলোকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। মাঠপর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সরকারের নীতিনির্ধারণেও প্রভাব রাখতে পেরেছে। 

বৈদেশিক সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে ভারতের অনীহা আছে। ভারত মনে করে, তাদের সঙ্গে কোনো লেজ ঝুলে থাকা ঠিক হবে না, কোনো বিদেশি পরামর্শ তাদের দরকার নেই। ভারতের সরকারগুলো সব সময়ই এনজিওগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। যে এনজিওগুলো বিদেশি সহায়তা নিয়ে চলে, তাদের আগেও হেনস্তা করা হয়েছে, এখনো করা হচ্ছে। একজন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে এনজিও নিয়ন্ত্রণের বিধিবিধান অনেক বেশি কড়া। আমাদের মনে হয় এই জায়গা থেকে ভারত সরকারের সরে আসা উচিত এবং এনজিওগুলোকে কম সন্দেহ ও আগের চেয়ে উদার দৃষ্টি নিয়ে দেখা উচিত। এতে ভারতেরই লাভ বেশি হবে। 

হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

মার্ক টালি প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক