ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতা ও উদারতা

মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্ব তার ‘ইলম’ তথা বুদ্ধি-বিবেক বা জ্ঞানের জন্য। এই জ্ঞানের জন্যই মানুষের অবস্থান ফেরেশতার ওপরে। মানুষকে মহান আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য। তাই মানুষের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানুষ পরিচালিত হয় তার স্বীয় ইচ্ছা অনুযায়ী। মানুষ ভালো-মন্দ বিচার করে যার যার জ্ঞানের আলোকে। জ্ঞানের ভিত্তি হলো তথ্য। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা সব নবী-রাসুলকে সত্য তথ্য প্রচারের জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, জোর করে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘যদি তারা বিমুখ হয়, তবে আমি আপনাকে তাদের জন্য রক্ষকরূপে পাঠাইনি। শুধু বাণী পৌঁছে দেওয়া ভিন্ন আপনার কোনো দায়িত্ব নেই’ (৪২: ৪৮)। ‘(হে রাসুল!) আপনি উপদেশ দিন, আপনি উপদেশদাতা ভিন্ন নন। আপনি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নন। তবে যারা মুখ ফিরিয়ে নেবে ও কুফরি করবে, আল্লাহ তাদের মহাশাস্তি দেবেন। তারা আমার কাছেই ফিরে আসবে এবং তাদের হিসাব গ্রহণ আমারই দায়িত্বে’ (৮৮: ২১-২৬)। 

ইমান বা বিশ্বাস হলো জীবনব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এই ইমান আনার ক্ষেত্রে ইসলামে বলপ্রয়োগের বা জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের, হেদায়াত ও গোমরাহির বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা ছিল নবী-রাসুলদের দায়িত্ব। ইমান আনা না-আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘দ্বীন সম্পর্কে জোরজবরদস্তি নেই, সত্য ভ্রান্তি হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে
অস্বীকার করবে ও আল্লাহে ইমান আনল, সে এমন এক মজবুত হাতল ধারণ করল, যা কখনো ভাঙার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)। 

ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও উদারতা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দুটি গুণ। এর বিপরীত হলো ধৈর্যহীনতা, অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতা, কার্পণ্য, হীনতা, নীচতা, অভব্যতা। এসব আল্লাহ তাআলার অপছন্দের। যাদের অন্তর বদগুণ থেকে মুক্ত হয়েছে, তারাই সফল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সেদিন সম্পদ ও সন্তান (শক্তি) কোনো কাজে আসবে না, বরং যারা আল্লাহর সমীপে উপনীত হবে গরলহীন অন্তরে’ (২৬: ৮৮-৮৯)। 

কারও সঙ্গে দ্বিমত, ভিন্নমত বা মতপার্থক্য হলে তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়, তুমি প্রতিহত করো মন্দকে তা দিয়ে যা উত্তম; ফলে তোমার ও যার মধ্যে চরম শত্রুতা, সে তোমার পরম বন্ধুতে পরিণত হবে’ (৪১: ৩৪)। 

সংকীর্ণতার বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘তারা বলে ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এটি তাদের অলীক আশা। বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ করো। হ্যাঁ, কেউ আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সত্কর্মপরায়ণ হয় তার ফল তার রবের কাছে রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই ও তারা দুঃখিত হবে না। ইহুদিরা বলে “খ্রিষ্টানদের কোনো ভিত্তি নেই” এবং খ্রিষ্টানরা বলে “ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই” অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই জানে না, তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা ফয়সালা করবেন’ (২: ১১১-১১৩)। 

বিচার ফয়সালার ভার আল্লাহ নিজের হাতে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা মোমিন আর যারা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ছাবিইন; তাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং সত্কর্ম করে, তবে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে বিনিময় রয়েছে’ (২:৬২)। ‘নিশ্চয় যারা মোমিন আর যারা ইহুদি, ছাবিইন, খ্রিষ্টান ও মাজুস এবং মুশরিক; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। আল্লাহ সবকিছু সম্যক প্রত্যক্ষকারী’ (২২: ১৭)। 

শান্তি স্থাপনের জন্য উদারতা, সহিষ্ণুতা ও ছাড় দেওয়া প্রয়োজন হয়। কারও সঙ্গে দ্বিমত হলেই বিরোধিতা ও ফতোয়া প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইন ও মুজতাহিদ ফকিহদের মধ্যেও ইমান, আকিদা, ইজতিহাদ ও ফিকহি মাসআলা এবং ব্যবহারিক পর্যায়ে অনেক বিষয়ে বহু মতভিন্নতা বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ও তাঁরা বিবাদে লিপ্ত হননি। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায়নি। (বুখারি: ২৮৯,৩৪০)। 

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক 

smusmangonee@gmail,com