জবলেস গ্রোথ সিনড্রোমের বিপদ

পোশাকশিল্পের প্রাথমিক পর্বে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী
পোশাকশিল্পের প্রাথমিক পর্বে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী

প্রথম আলোর ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখের শেষ পৃষ্ঠার শিরোনাম, ‘গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক কমছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। এখানেই বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের একটা বড় বিপদের ‘অশনিসংকেত’ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে তুলে ধরাই এই কলামের উদ্দেশ্য। এই বিপদের নাম ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে, মানে বিংশ শতাব্দীর আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকে পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী। ওই কারখানাগুলোর সিংহভাগই ছিল ‘কাটিং অ্যান্ড মেকিং’, মানে সেলাইনির্ভর ওভেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, নারী শ্রমিকেরা যে কাজগুলোতে পুরুষের চেয়ে বেশি পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিচারে নারী শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ছিল বেশি, কিন্তু মজুরি ছিল কম। এই দুটো বৈশিষ্ট্য থাকলেই শ্রমকে ‘সস্তা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা যায়। ওই পর্যায়ে নারী শ্রমিকদের নিয়মিতভাবে অনেক বেশি সময় খাটিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে নিটওয়্যার শিল্প দ্রুত বিকশিত হওয়ার পর নিটওয়্যার ফ্যাক্টরিগুলোতে পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নারীদের চেয়ে দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করে। ফলে যুক্তভাবে ওভেন ও নিটওয়্যার—এই দুই ধরনের তৈরি পোশাকশিল্পের মোট শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকের অনুপাত কমতে শুরু করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের এক জরিপ দেখাচ্ছে, ওই বছর পোশাক খাতে কর্মরত মোট ২৯ লাখ ৯৭ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ আর পুরুষ ছিলেন ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট ৩৩ লাখ ১৫ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে পুরুষের অনুপাত ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং নারীর অনুপাত কমে ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আরও লক্ষণীয় হলো, পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের মোট সংখ্যাও ২০১৩ সালের ১৭ লাখ ৪ হাজারের তুলনায় ২০১৮ সালে ১৫ লাখ ৩১ হাজারে নেমে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে বিজিএমইএ দাবি করে আসছিল, যদিও কোনো অজ্ঞাত কারণে পোশাকশিল্পের নেতারা এই শিল্পে প্রকৃতপক্ষে কত শ্রমিক কাজ করছেন, সেটার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকাশে অনীহ ছিলেন। তাঁদের বহুল প্রচারিত ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় হয়তো তাঁরা এ ব্যাপারে রাখঢাক করতেন!

এখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা গেড়ে রয়েছে যে পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে, অথচ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের জরিপে শ্রমিকের সংখ্যা পাওয়া গেল ৩৩ লাখের সামান্য বেশি। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পোশাক খাতে পুরুষ শ্রমিকের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আর নারী শ্রমিকের অনুপাত কমেছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অথচ প্রতিবছর নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে এবং এই খাতের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও ক্রমবর্ধমান।

নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, এক দশক ধরে পোশাকশিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। এসব যন্ত্র একই সঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে। তাই আগে যেসব কাজ নারী শ্রমিকেরা করতেন, সেগুলো এখন যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। এখন সুয়িং, ফিনিশিং, কাটিং, এমব্রয়ডারি, নিটিং ও ওয়াশিং—মূলত এই ছয় ধরনের কাজ হয় বাংলাদেশে।

নারীরা এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেন সুয়িংয়ে, এরপর ফিনিশিংয়ে। অন্য কাজগুলোতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ তেমন নেই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই নতুন কাজগুলোতে দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে নারী শ্রমিকেরা নাকি তেমন আগ্রহ দেখান না। বরং পুরুষ শ্রমিকেরা নতুন প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণে প্রবল আগ্রহী। আর নারী শ্রমিকেরা গড়ে শ্রমিক হিসেবে নাকি কাজ করেন সাত বছর, তারপর তাঁরা সাংসারিক দায়িত্বে জড়িয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থাপনায়ও পোশাক খাতের মালিকেরা নারীদের নিয়োগ দেন না মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, দক্ষ ও শিক্ষিত নারী ব্যবস্থাপকও পোশাক খাতে তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। অন্যদিকে এখন পোশাকশিল্পের মজুরি খানিকটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষ শ্রমিকেরাও এই খাতে কাজ পেতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ওপরের যে বিষয়গুলো উদ্‌ঘাটন করেছেন কিংবা বিভিন্ন গবেষকের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশ করেছেন, সেগুলো নিয়ে গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ, এ দেশের শিল্পায়নে তৈরি পোশাক খাতকে একটি বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি এই খাতে ব্যাপকসংখ্যক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে একটি ‘বৈপ্লবিক অর্জন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই প্রথমবার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশ্রমিক হিসেবে ব্যাপক হারে নারীরা বাড়ির বাইরে এসে কর্মে নিয়োজিত হওয়ায় এ ব্যাপারে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, সেটাকে একটা ‘বিপ্লব’ বললে বাগাড়ম্বর হবে কি?

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যখন সমাজে ধর্মীয় রাজনীতি ও তাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে চলেছে, সেখানে স্রোতের বিপরীতে নারীসমাজের ক্ষমতায়নে পোশাকশিল্পে নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থান আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকে একটা ‘বিপ্লব’ই ছিল! ‘নারীর ক্ষমতায়নে’ বাংলাদেশ যে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পাশাপাশি সামনের কাতারে অবস্থান করে নিয়েছে, সেটার অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে পোশাকশিল্পে সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের নারীসমাজকে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য। অতএব, এই খাতে নারী শ্রমিকের ক্রমহ্রাসমান কর্মসংস্থানকে ভবিতব্য মেনে নিলে ভুল হবে।

কিন্তু এ সমস্যাটার যে দিকটিতে আমি মূল দৃষ্টি দিতে চাই তা হলো, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তারের ফলে ক্রমেই কৃষি, শিল্প এবং সেবা ও বাণিজ্য খাতের সব উৎপাদনক্ষেত্রে শ্রমিকের আনুপাতিক প্রয়োজন দিন দিন সংকুচিত হওয়ার যে প্রবণতা বিশ্বে শক্তিশালী হয়ে চলেছে, সেটাকে মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর ফলে যে সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠছে, সেটাকেই বলা হয় ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’। যেসব জনবহুল দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান, সেখানেই ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার ফলে দেশগুলোতে জিডিপি বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকার সমস্যা যতখানি কমে আসার কথা, ততখানি কমানো যাচ্ছে না। 

অনেক উন্নয়নতাত্ত্বিক এই সমস্যাকে ‘ক্রমহ্রাসমান এমপ্লয়মেন্ট ইলাস্টিসিটি’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন, কিন্তু সমস্যাটির সমাধান যে দুরূহ, সেটাও ক্রমেই উন্নয়নচিন্তকদের লেখায় ফুটে উঠছে। চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটা প্রধান ডাইমেনশন হিসেবে উন্নত দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স’-এর উদ্ভাবনকে যেভাবে অগ্রাধিকারে পরিণত করা হয়েছে, তার ফলে শ্রমঘন প্রযুক্তিকে পিছু হটিয়ে ক্রমেই যন্ত্রনির্ভর ও রোবটনির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকবে। অতএব প্রযুক্তি বিকাশের চরিত্রের কারণে বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যা–অধ্যুষিত দেশের জন্য কর্মসংস্থান ইস্যুটা আরও জটিল হয়ে পড়বে। এই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হলে দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত আধুনিকায়নের পথেই এগোতে হবে।

আমাদের সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের শিক্ষাবঞ্চিত নারীরা পোশাকশিল্পে তাঁদের সহজাত দক্ষতা অর্জনক্ষমতার সহায়তায় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ পোশাকশিল্পে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞাননির্ভর আধুনিক মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় নারী শ্রমিকেরা দক্ষ টেকনিশিয়ান হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁরা কম্পিউটার চালাতে পারছেন না, কম্পিউটারচালিত যন্ত্রপাতিও চালাতে অপারগ। অতএব, তাঁরা ছিটকে পড়ছেন জটিল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী কাজগুলো থেকে। এমনকি আমাদের পোশাকশিল্পে যে দুই লাখের মতো দক্ষ বিদেশি টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপক লোভনীয় বেতনে কর্মরত, সে চাকরিগুলোতে আমাদের দেশের দক্ষ টেকনিশিয়ান, প্রফেশনাল পাওয়া যাচ্ছে না বলে পোশাকশিল্পের মালিকেরা অভিযোগ করে চলেছেন। ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন থেকে এ ধরনের দক্ষ টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপক জোগাড় করতে তাঁরা নাকি বাধ্য হচ্ছেন!

শুধু পোশাকশিল্পেই নয়, ‘জবলেস গ্রোথ’ পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা হিসেবে গেড়ে বসেছে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছালেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাত ২৩ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মানে প্রধানত ভোগ, সরকারি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির কারণে জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের অবদান তেমন বাড়ছে না। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৮ লাখ কর্মসংস্থানপ্রত্যাশী মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্য থেকে ছয়-সাত লাখ মানুষের যেনতেনভাবে বিদেশে অভিবাসন অব্যাহত থাকায় একটা ‘সেফটি ভাল্‌ভ’ হিসেবে এই প্রবাহ বেকার সমস্যাকে আড়াল করে চলেছে।

আদম ব্যাপারীদের লাখ লাখ টাকার খাই মিটিয়ে দেশের যে অভিবাসনে ইচ্ছুক তরুণেরা বিশ্বের পথে-প্রান্তরে প্রাণ হারাচ্ছেন কিংবা সাগর-মহাসাগরে ডুবে মরছেন, তাঁদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যতই কটাক্ষ করুন, এই বিদেশে পালাতে মরিয়া তরুণেরা শুধুই শিক্ষিত বেকারদের মধ্য থেকে আসছেন না, এটা দেশের গ্রামীণ-শহুরেনির্বিশেষে অর্ধবেকার যুবকদের মরণপণ জীবন-জীবিকার সংগ্রামও। এই ‘জবলেস গ্রোথ সিনড্রোম’ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক