ভূমি নিবন্ধনে দুর্নীতি রোধ

ভূমি নিবন্ধনসেবার প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নতুন গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বিস্ময় নেই। ব্যতিক্রম ছাড়া, মানুষের ধারণায় প্রতিটি সাবরেজিস্ট্রি অফিস একটি করে দুর্নীতির আখড়া। এটা রোধ করতে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু করণীয় আছে। কিন্তু কে করবে?

ভূমি নিবন্ধন অধিদপ্তরের প্রধান নির্বাহী হলেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন (আইজিআর) জ্যেষ্ঠ জেলা জজ। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় আইজিআর নিয়োগ দিয়ে থাকে। আইন বলছে, কোনো জেলায় সাবরেজিস্ট্রারের অনুপস্থিতিতে জেলা জজ দায়িত্ব পালন করবেন। এই যখন অবস্থা, তখন বিচার বিভাগ কী প্রক্রিয়ায় ভূমি নিবন্ধন কার্যক্রমে দুর্নীতি রোধে কার্যকর হস্তক্ষেপ করে থাকে, তাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এই প্রশাসন আইন না ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে—তা নিয়ে রশি টানাটানির অবসান ঘটেনি। এই প্রশ্নে একটি রিট দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন। এটি আসলে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিবন্ধনসেবা খাতের দুর্নীতির বিষয়ে বিচার বিভাগ নীরব দর্শক থাকতে পারে না।

বর্তমান আইজিআর কর্মরত জেলা জজ থাকতে আইজিআর হওয়ার পরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, যা নজিরবিহীন। দেশে প্রতিদিন এক লাখের বেশি দলিল হয়। সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে এক হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়। এখানে দুর্নীতির গভীরতা বুঝতে এই একটি তথ্যই যথেষ্ট। অথচ আইজিআর এসবের রাশ টানতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তার ফল কী, সে বিষয়ে তঁার দপ্তরের তরফে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এ রকম একটি জনগুরুত্বসম্পন্ন দপ্তর বছরে এক বছরের জন্যও প্রেস ব্রিফিং করে না।

সার্বিক বিবেচনায় আমরা মনে করি, ভূমি নিবন্ধনসেবা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো দরকার। দলিল জনগণের দৈনন্দিন ও দূরবর্তী জীবনে গভীরতর ছাপ রাখছে। অথচ দলিল প্রশাসনটি পরিচ্ছন্ন নয়। যেমন ১৮৯ জন সাবরেজিস্ট্রারের নিয়োগ ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সাহসী সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম সচিব মজনুল আহসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি (বর্তমানে এর দুজন হাইকোর্টের বিচারপতি) ২০১১ সালে অনিয়ম উদ্ঘাটন করেন। কমিটি দেখতে পান যে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে আত্তীকরণের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ১৮৯ জনের মধ্যে ১০৯ জনের বয়স ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে ৩ বছর থেকে ১১ বছর ছিল। তঁাদের অধিকাংশ এখনো কর্মরত। তদন্তে গোড়াতে সংসদীয় কমিটি সম্পৃক্ত থাকলেও পরে তঁাদের আগ্রহ হারানো ছিল রহস্যাবৃত।

সংস্কার আনা কঠিন, কিন্তু দুটি সিদ্ধান্ত এখনই কার্যকর করা সম্ভব। নগদ টাকার লেনদেন বন্ধ করা এবং দলিল নিবন্ধনের দিনেই পক্ষকে মূল দলিল সরবরাহ করা। এই দুটিই দুর্নীতির বড় উৎস। ২০০৭ সালে মাসদার হোসেন আইজিআর থাকতে সুনামগঞ্জে এক পিয়নের কাছ থেকেই পাঁচ কোটি টাকা উদ্ধার হয়। তখন প্রথমবারের মতো আইন করা হয় যে সব ধরনের ফি ব্যাংক ড্রাফটে নিতে হবে। সেই থেকে সিংহভাগ ফি ব্যাংকে নেওয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কিছু খাতের ফি নগদ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়। এটা বন্ধ করে শতভাগ টাকা ব্যাংকে বা অনলাইনে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মূল দলিলের নকল পেতে এক থেকে দুই বছর লাগানোর রীতি বহুমাত্রিক দুর্নীতি ও জনভোগান্তির জননী। মাসদার হোসেন একত্রে দলিলের তিনটি মূল কপি করে তাৎক্ষণিক দলিল গ্রহীতাকে সরবরাহের বিধান করেছিলেন। তেজগাঁওয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে এটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুও হয়েছিল। এই বিধান এখনই কার্যকর করা হলে কিছুটা হলেও দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে।