উল্টো পথে গাড়ি, উল্টো পথে রাজনীতি

দিন কয়েক আগে হানিফ বাংলাদেশি নামের এক তরুণ প্রথম আলো অফিসে এসেছিলেন। তিনি বললেন, নৈতিক অবক্ষয় রোধে ২ সেপ্টেম্বর থেকে ৬৪টি জেলায় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন দলের হয়ে কাজ করছেন? বললেন, না, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দরে একটি সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এই কর্মসূচি পালন করতে দুই মাসের ছুটি নিয়েছেন। আর নামের শেষে বাংলাদেশি শব্দটিও পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নয়। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ হানিফ। ভোটের অধিকারের দাবিতে তিনি গত ১৪ মার্চ-এপ্রিলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪ কিলোমিটার পদযাত্রা করলে বন্ধুরা তাঁকে হানিফ বাংলাদেশি নামে ডাকেন। এখন তিনি এই নামেই বেশি পরিচিত।

তারপরও মনে হয়েছিল এটি হয়তো তাঁর কথার কথা। একজন তরুণের পক্ষে ৬৪ জেলায় স্মারকলিপি দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই খবর পেলাম, হানিফ ২ সেপ্টেম্বর সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ করার মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু করেছেন। শেষ করবেন ২০ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে।

গতকাল শুক্রবার টেলিফোনে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তিনি ছিলেন গাইবান্ধায়। আগের দিন বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন। এর আগে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুরেও স্মারকলিপি দিয়েছেন। শুক্র ও শনিবার সরকারি অফিস বন্ধ। রোববার আবার কাজ শুরু করবেন। জানতে চাই, স্মারকলিপি দিতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, কোথাও বাধা পেয়েছেন কি না। হানিফ জানান, কেউ তাঁকে বাধা দেয়নি। বরং কোনো কোনো জেলা প্রশাসক তাঁর এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন, তিনি (হানিফ বাংলাদেশি) যেমন নৈতিক অবক্ষয় দূর করতে চান, প্রশাসনও একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে। যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে সমাজ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি একেবারে লোপ না পেলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে কোনো কোনো জেলা প্রশাসক ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। অধস্তন কারও কাছে স্মারকলিপি দিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

হানিফের কাছ থেকে জানা গেল, ভোটের অধিকারের দাবিতে পদযাত্রাকালে ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় যাঁরা তাঁর বন্ধু হন, তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করছেন। অনেকে কর্মসূচিতেও যোগ দিচ্ছেন। এতে প্রমাণিত হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু মন্দ কাজে ব্যবহৃত হয় না, একে ব্যবহার করে ভালো কাজই বেশি হয়।

এবার দেখা যাক হানিফ বাংলাদেশি স্মারকলিপিতে কী বলেছেন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হলেও দেশে দুর্নীতি না কমায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক অনাচার রুখে দিতে বলেছেন। স্মারকলিপিতে তিনি আরও বলেছেন, ‘সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই ঘুষ-দুর্নীতি, সামাজিক, মানবিক, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চলছে। গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ছোট ছোট মেয়েকে
ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একে অন্যকে কুপিয়ে হত্যা করছে। নারী-শিশু নির্যাতন মহামারি আকার ধারণ করেছে। পরস্পর দোষারোপ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি অবক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। চলমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির অবসান হলে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে, প্রতিটি নাগরিক তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে অবক্ষয় নির্মূল সম্ভব। আসুন দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হই।’

এতে দলীয় রাজনীতির কথা নেই। কোনো দলকে ক্ষমতা থেকে নামানো কিংবা ক্ষমতায় বসানোর কথা নেই। আছে সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের কথা। দেশ ও সমাজের প্রতি নাগরিকদের দায়বদ্ধতার কথা।

আমরা জানি না এই তরুণের পেছনে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন আছে কি না। কিংবা তাঁর ভালো কাজকে ব্যবহার করে কোনো দল তাঁকে বিপথে নিয়ে যায় কি না। আমাদের সমাজে যেমন ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক ভালো কাজের উদাহরণ আছে, তেমনি তাঁদের বিপথে চালিত করারও বহু লোক আছে। বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতি যখন দেখে কোনো তরুণের মধ্যে সম্ভাবনা আছে, তখন তাঁকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। গোলাম ফারুক ওরফে অভি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। রাজনীতির কুশীলবেরা কীভাবে তঁাকে সন্ত্রাসের হাতিয়ার করেছিলেন, তা সবার জানা। গত বৃহস্পতিবারের ইত্তেফাক-এর শেষ পৃষ্ঠায় একটি খবর দেখে চমকে উঠলাম, ‘স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত হোসেন’। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাওয়া মানে তিনি অস্বাভাবিক জীবনে আছেন। তিনি নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা বলে দাবি করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন।

ব্যক্তি হানিফ বাংলাদেশির একক কর্মসূচি আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মারকলিপিতে িতনি যেসব কথা বলেছেন, তার কোনোটি মিথ্যা নয়। দেশব্যাপী অনাচার-অবিচার হচ্ছে, অথচ কেউ প্রতিবাদ করছেন না। সবাই নিশ্চুপ। আগে এ রকম ছিল না। সরকারি দল ভুল করলে বিরোধীরা সেটি ধরিয়ে দিতেন। প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু যখন সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ে ভুল করে, তখন আর ভরসা রাখার জায়গা থাকে না।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, সরকার তাঁদের রাস্তায় নামতে দেয় না। কিন্তু জনগণের দাবি ও জনজীবনের সমস্যা নিয়ে তো তাঁরা কোনো কর্মসূচি দিচ্ছেন না। বাইরে কিংবা ঘরে। দলীয় দাবিতে কর্মসূচি নেন। সামাজিক অবক্ষয়, অনাচার নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। নেতারা ভাবেন, ক্ষমতায় গেলে সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন। বিএনপির একেক নেতা একেক রকম কথা বলেন। দলটিতে শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। স্থায়ী কমিটি সর্বোচ্চ ফোরাম হলেও এর সদস্যরা জানেন না কোথা থেকে কোন সিদ্ধান্ত অাসে।  

একসময় বাম দলগুলো জনজীবনের সমস্যা নিয়ে সভা-সমাবেশ করত, কর্মসূচি দিত। মানুষকে সজাগ করত। ভোটের রাজনীতিতে জয়ী হতে না পারলেও তাদের ওপর মানুষ এক ধরনের আস্থা রাখত। কিন্তু বামেরা ভাঙতে ভাঙতে এমন প্রান্তিক অবস্থায় এসেছে, রাজপথে একটা জোরদার কর্মসূচি পর্যন্ত পালন করতে পারেন না। বাম নেতারাও মানুষের কাছে যান না। রাতে টক-শোতে তাঁদের বাগাড়ম্বর দেখে মনে হয়, বোকা বাক্সে কথা বলেই তারা দেশে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করবেন। সমাজবিপ্লব এগিয়ে নেবেন।

আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। এই যে দেশব্যাপী সামাজিক অবক্ষয়-অনাচার চলছে, তার পেছনেও আছে রাজনীতি। রাষ্ট্র ও সমাজে নৈতিক সংকট দেখা দিলে রাজনীতি পথ দেখাবে, এটাই সবাই আশা করেন।

দুর্ভাগ্য হলো, ৪৮ বছর ধরেই আমাদের রাজনীতির কুশীলবেরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। এ কারণে ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিবেকের পাহারাদার হন। আর ক্ষমতার বারান্দায় ঠাঁই পেলেও চুপ হয়ে যান। ক্ষমতার বাইরেও যে জনমানুষের কল্যাণের রাজনীতি আছে, সেসব কথা তাঁরা ভুলে যান। আমরা প্রায় প্রতিদিনই ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতাদের মুখে বাহাস শুনি। এক পক্ষ তীব্র ভাষায় অপর পক্ষের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। দুই পক্ষের এই পাল্টাপাল্টিতে জনগণের সমস্যা ও সংকট আড়ালে পড়ে যায়। রাজনীতি এখন আত্ম–উন্নতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

সদ্য প্রয়াত প্রবীণ রাজনীতিক মোজাফফর আহমদ ঠাট্টা করে বলতেন, ‘রাজনীতিতে এখন “পলিট্রিকস” ঢুকে গেছে।’ রাজনীতি হলো জনগণের কল্যাণের জন্য। আর পলিট্রিকস হলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য। মোজাফফর সাহেবরা অনেক ত্যাগ স্বীকারের পরও রাজনীতিকে এই ‘পলিট্রিকস’ থেকে বের করে আনতে পারেননি। এমনকি নিজেদের দলকেও ঠিক রাখতে পারেননি। তাই রাজনীতি এখন উল্টো পথে চলছে।

রাস্তায় গাড়ি উল্টো পথে চললে বিশৃঙ্খলা হয়। ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় যানবাহন কোনো দিকে যেতে পারে না। সড়ক-মহাসড়কে প্রতিদিন আমরা এ দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত। তবে রাস্তা থেকে গাড়ি সরিয়ে চলাচল উপযোগী করা কঠিন নয়। কিন্তু উল্টো পথে চলা আমাদের রাজনীতি এমন গাড্ডায় পড়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসার আপাতত কোনো উপায় দেখছি না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]