'আন্ধা কানুন' গ্যাংবাজির সমাধান নয়

প্রথম আলো প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো প্রতীকী ছবি

সেই কিশোরেরা নেই, এই সব গ্যাংবাজ আছে। কিশোর আন্দোলনকারীরা দেশবাসীকে আবেগে কাঁদিয়েছিল আর কিশোর গ্যাংগুলো হয়েছে সামাজিক উপদ্রব। সেই কিশোরেরা রাষ্ট্র মেরামতের আশায় ভাসিয়েছিল দেশকে, আর গ্যাংবাজির কিশোরেরা হয়েছে বিষবৃক্ষের কচি ফল। দেবদূতের মতো যারা এসেছিল, তাদের প্রস্থান হয়েছিল কাঁদতে কাঁদতে। রাজপথ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল ‘অপরাধী’ তাড়ানোর কায়দায়। নিরীহ হওয়াই ছিল তাদের অপরাধ। তাদের আর দেখি না। এখন কিশোর অপরাধী দেখি, গ্যাংবাজির খুনখারাবি দেখি।

সরকার মনে হয় এর পুলিশি সমাধানে হাত দিয়েছে। গোড়ায় হাত না-দেওয়া সমাধানে আমরা মোটামুটি ওস্তাদ এক জাতি। পাইকারি হারে কিশোরদের ধরা হচ্ছে। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার গল্পের মতোই। ধুলা-কাদার ভয়ে রাজপথ সোনায় বা লোহায় মোড়ানোর চেয়ে নিজের পায়ে জুতা পরাই উত্তম। ‘নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ কিশোর মাস্তান-সন্ত্রাসী কারা, তা জানতে জনে জনে দৌড়ানি দেওয়ার দরকার নেই। স্থানীয় ক্ষমতাসীন সংগঠনের সংশ্লিষ্ট নেতাদের জিজ্ঞেস করুন: ভোটকেন্দ্র ভোটারদের থেকে ‘নিরাপদ’ রাখতে তাঁরা কাদের ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের মিছিল-মিটিংয়ের জনতার জোগান কারা দেয়? কারা দাপট ধরে রাখে এলাকায়? গরমের জন্য বালুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাভ নেই। সূর্যটা কোথায় তা জানলেই হয়। দখলদারি রাজনীতিতে কিশোরদের তাদের পদাতিক সৈন্য হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করলেই কিশোর অপরাধ বিপুল মাত্রায় কমে যাবে।

অন্য এক সমাধানের নজির হয়ে আছে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব। ম্যানচেস্টার ইংল্যান্ডের শিল্পশ্রমিকের শহর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর মারামারি আর ছোরা-সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যায়। রাস্তায় প্রায়ই দুই গ্রুপের মারামারি লেগে যেত; শিকার হতো সাধারণ পথচারীরাও। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ একটা বুদ্ধি করলেন। তাঁরা শহরজুড়ে শ্রমিক-যুবকদের ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। তরুণ বয়সের গরম রক্ত সুস্থ খাতে বইয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তারা মাস্তানি ছেড়ে দিল। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সে সময়ই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস।

আধুনিক সময়েও ব্রাজিল ও কলম্বিয়া এই কৌশল নিয়ে সফল হয়েছে। মাস্তানপ্রবণ এলাকায় ফুটবল ক্লাব গড়ে দেওয়ার পর দেখা যায়, অপরাধ কমে গেছে। ওসব দেশ যে নিয়মিতভাবে ফুটবল প্রতিভা তুলে আনতে পারে, তার কারণ এসব সমাজমুখী উদ্যোগ। আমাদের কিশোর-তরুণেরা পাড়ায় পাড়ায় গ্যাংবাজি করে বেড়াচ্ছে। খুনোখুনি ও নেশায় নিজেরাও মরছে, দেশটাকেও ভোগাচ্ছে। যে মানসিক জোশ তাদের গ্যাং বানায়, সেই জোশকে খেলাধুলার মতো মজার খাতে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। দুঃখিত, এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের অভাব। রাজনৈতিক মাফিয়াতন্ত্র সহিংসতার জোশ জিইয়ে রাখছে নিজের গরজে। তাই যে গ্যাংগুলো ফুটবল ক্লাব হয়ে উঠতে পারত, তারা নির্বাচনের মাঠ দখলের পদাতিক হিসেবে প্রশিক্ষিত হচ্ছে।

আমরা বলে আসছি যে কিশোর-তরুণেরা ঝুঁকিতে আছে। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের ওপর যৌন নির্যাতন ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। আবার এরাই পড়ে গেছে বিপজ্জনক সব নেশার জালে। এখন তাদের তাড়া করছে পুলিশ। কোথাও কিশোর-তরুণদের ধরে চুল কেটে দেওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাইরে পেলে আটক করা হচ্ছে। এটা কোনো জীবন হলো?

কিশোরদের গ্যাংবাজি-সন্ত্রাস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করা হচ্ছে কেন? কিশোর-তরুণ মানেই সন্দেহভাজন; এই ‘আন্ধা কানুন’ চালাতে চাইছে প্রশাসন? ব্যাপারটা কি মাদকবিরোধী যুদ্ধের মতো হয়ে যাচ্ছে না? পালের গোদাদের না ছুঁয়ে চুনোপুঁটি কিংবা একেবারে নিরীহদের ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছিল বলে সে সময় শোরগোল উঠেছিল। এটা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা যে মাদক ব্যবসার গোড়াটা কোথায়!

যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাবালকেরাই বোবা হয়ে থাকে, সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের দাপাদাপি চলতে পারে কিসের জোরে? কথায় বলে ছাগল নড়ে খুঁটির জোরে। তাদের খুঁটিটা কোথায়?

কিশোরেরা অনুকরণপ্রিয়। অতি অল্প বয়সে তারা সহিংসতা, মাস্তানি, ব্যাটাগিরি দেখে অভ্যস্ত হলে সেটাকেই তারা আদর্শ মডেল হিসেবে ধরে নেয়। কিশোরদের বিচ্ছিন্ন গ্রুপ থাকতে পারে। তবে অধিকাংশই বিশেষ কোনো ভাই বা দলের নামের বাহাদুরিতে চলে। পুলিশ এসব ঠিকই জানে। ক্ষমতার পাইপলাইন কাটা পড়লেই গ্যাংবাজির প্রতাপ তলানিতে নেমে আসবে। সব জেনেও তাহলে গণহারে কিশোরদের দৌড়ানির ওপর রাখার কারণ কী? সরকারের কোনো মহল কি কিশোরদের হুমকি মনে করছে? কিশোরদের সম্ভাব্য সংগঠিত হওয়ার বিরুদ্ধে এটা কি তাঁদের প্রি-অ্যাম্পটিভ অ্যাটাকের কায়দায় আগাম ব্যবস্থা?

বখাটেদের উৎপাত, গ্যাংবাজির ত্রাস, মাদকাসক্তি, ইভ টিজিং তো সত্যিই সমস্যা। অপরাধমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কৈশোরিক প্রতিবিম্ব হলো এসব ঘটনা। স্বৈরাচারীর মতো তারা ভাবে, তোমার ভয়ই আমার আনন্দ, আমার ক্ষমতা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জয় দিয়ে নয়, ভয় দিয়ে আমরা শাসন করতে ভালোবাসি। ভয়ের শাসনের দাপট পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যন্ত। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুম-হত্যা ও নির্যাতনের রাষ্ট্রীয় চর্চারই নকল করে এই সব উঠতি সন্ত্রাসী। ‘গ্যাং কালচার’ ভয়ের শাসনেরই কৈশোরিক প্রতিবিম্ব।

উঠতি বয়সের কিশোরেরা দাপুটে মাচো বা ‘ব্যাটাগিরি’ ভালোবাসে। তারা বীর-নায়ক হতে চায়। সুস্থ সমাজে তাদের এই অভিলাষ পূরণ হয় সুস্থ পথে। রোমাঞ্চকর অভিযান, অন্যায়ের প্রতিরোধ কিংবা জনহিতকর কাজে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের সেসব পথ বন্ধ। ক্লাবগুলো, মাঠগুলো, স্কুল-কলেজের প্রতিনিধিত্বকারী পদগুলো কাদের দখলে? এ রকম অবরুদ্ধ সমাজ মাইনফিল্ডের মতো। এখানে-ওখানে এর-ওর মনে বারুদ জমছে। সেটাই তারা জ্বালাচ্ছে-ফাটাচ্ছে নিজেদেরই বিরুদ্ধে।

নিরানন্দ জীবন আর প্রশাসনের চাপ—দুদিকেই তারা ঝুঁকিতে। কিশোরেরা ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আর কতভাবে আমরা ঝুঁকিতে রাখব?

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]