খেলার মধ্য দিয়ে পুনরুদ্ধার ও একটি ফুলের কথা

আইরির ফুল। ছবি: মনজুরুল হক
আইরির ফুল। ছবি: মনজুরুল হক

জাপানে ২০১১ সালের মার্চ মাসে আঘাত হানা ভূমিকম্প আর সুনামি জলোচ্ছ্বাসের পর আট বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অনেকের মনেই সেই স্মৃতি এখন ঝাপসা, বিশেষ করে দুর্যোগ আঘাত হানা অঞ্চল থেকে অনেক দূরে যাঁদের বসবাস। তবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক এলাকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেদনা আর আঘাতের ক্ষত ধীরে শুকিয়ে গেলেও দুর্যোগে যাঁরা আপনজনদের হারিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে এখনো ফিরে আসছেন হারিয়ে যাওয়া স্বজনেরা।

উত্তর-পূর্ব জাপানের মিয়াগি জেলা হচ্ছে ২০১১ সালের সুনামি আর ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি। দুর্যোগের আট বছর পর কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় চালানো পুনর্গঠন তৎপরতার কল্যাণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক এলাকা এখন নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। আগামীর সুনামি যেন শিগগিরই আঘাত হেনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে না পারে, তা নিশ্চিত করে নিতে এমনকি কিছু কিছু শহরের কেন্দ্রস্থল পুরোনো জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। তবে জনসাধারণের ব্যবহারের অবকাঠামো মেরামত কিংবা নতুন করে গড়ে নেওয়ায় বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হলেও স্থানীয় যেসব লোকের বসতবাড়ি সুনামির ঢেউয়ে ভেসে গেছে কিংবা ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাঁদের অনেকেই গৃহনির্মাণ সহায়তা সেভাবে না পাওয়ায় নতুন করে জীবন গড়ে নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না। ফলে সুনামি-বিধ্বস্ত এলাকাগুলো থেকে অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকায় ছোট অনেক শহরকেই জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার মতো সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সে রকম অবস্থায় মানুষকে উদ্দীপ্ত করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের সক্রিয় রাখার মধ্য দিয়ে জনজীবনে নতুন প্রাণসঞ্চারের কিছু কর্মসূচিও সেই অঞ্চলগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে হাতে নেওয়া হচ্ছে। সে রকম কর্মসূচির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে খেলাধুলার আয়োজন হচ্ছে অন্যতম।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা জাপান প্রায় নিয়মিতভাবে আয়োজন করে থাকে। ক্রীড়াক্ষেত্রে জাপানের এ রকম স্বাগতিক ভূমিকা পালনের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের মধ্য দিয়ে, যে ধারা আজও অব্যাহত। খেলাধুলার আন্তর্জাতিক যেসব প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব জাপান পালন করছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সে রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আংশিকভাবে উত্তর-পূর্ব জাপানের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটির ক্রীড়া উদ্যোক্তারা অঞ্চলের লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে চলেছেন। চলতি মাসের ২০ তারিখ থেকে জাপানে শুরু হতে যাওয়া রাগবি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের কয়েকটি খেলা যেমন সুনামি আর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ফুকুশিমা এবং ইওয়াতে জেলায় অনুষ্ঠিত হবে।

আইরির ফুল। ছবি: মনজুরুল হক
আইরির ফুল। ছবি: মনজুরুল হক

বিশ্বকাপ ফুটবলের মতোই রাগবির বিশ্বকাপের বেলায়ও প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়িত্ব একক কোনো শহরের ওপর নয়, বরং সারা দেশের ওপর বর্তায়। এ কারণেই সেসব খেলায় প্রতিযোগিতার স্থান সাধারণত নির্ধারিত হয়ে থাকে দেশজুড়ে। ফলে সে রকম প্রতিযোগিতায় স্থান নির্বাচনে সারা দেশকে হিসাবের মধ্যে রাখা তুলনামূলকভাবে সহজ।

এর বিপরীতে অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব দেশের ওপর নয়, বরং একক কোনো শহরের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অলিম্পিকের সব রকম প্রতিযোগিতা মূলত সেই শহরেই অনুষ্ঠিত হয়, যদিও বিশেষ সুবিধার কথা বিবেচনা করে আশপাশের কিছু কিছু এলাকাকেও অলিম্পিকের স্বাগতিক শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। সে রকম হিসাব থেকে আগামী বছরের গ্রীষ্মে টোকিওতে নির্ধারিত অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সব খেলাই হওয়ার কথা জাপানের রাজধানী ও আশপাশের শহরগুলোতে। তবে ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ হিসেবে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ফুটবল ও বেসবলের মতো প্রতিযোগিতার বেলায় বাছাইপর্বের কিছু খেলার স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে টোকিও থেকে অনেক দূরে, ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত মিয়াগি ও ফুকুশিমা জেলায়। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের আয়োজকেরা দূরের সেই জেলাগুলোতে অলিম্পিকের কিছু খেলা নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে খেলাধুলার আয়োজনকে ঘিরে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন এবং তাঁদের পরিবারকে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্য ধরে নিয়েছেন। ফলে অলিম্পিক এগিয়ে আসার মুখে উত্তর-পূর্ব জাপানের বেশ কিছু শহরে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য এখন লক্ষ করা যাচ্ছে।

এ ছাড়া অলিম্পিকের মশাল শোভাযাত্রাও ২০২০ সালের জুন মাসে বিভিন্ন জায়গা পরিক্রমণ করবে। মিয়াগি জেলার নির্ধারিত কয়েকটি অলিম্পিক ভেন্যু এখন সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। জেলার প্রধান শহর সেন্দাই থেকে অল্প দূরে অবস্থিত রিফু টাউনের ফুটবল স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে, ২০০২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন সামনে রেখে। সেই একই স্টেডিয়ামে আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে টোকিও অলিম্পিকের পুরুষ ও নারীদের ফুটবলের বাছাইপর্বের কয়েকটি খেলা। ফলে প্রায় দুই যুগ আগে তৈরি হওয়া সেই স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজ এখন পুরোদমে এগিয়ে চলেছে এবং ৩৬ হাজার জনসংখ্যার শহরটি এখন নতুনভাবে আবারও জেগে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অলিম্পিক ফুটবল আয়োজনের প্রস্তুতি চলতে থাকার পাশাপাশি দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠায় মিয়াগিতে চালানো প্রচেষ্টা এবং ভূমিকম্প ও সুনামির স্মৃতি ধরে রাখতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাতে নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কেও অলিম্পিক উপলক্ষে আসা অতিথিরা যেন জানতে পারেন, সেই চেষ্টাও নানাভাবে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে রকম হৃদয়স্পর্শী এক উদ্যোগের কথা গতকাল শনিবার বিদেশি সাংবাদিকদের শোনালেন রিফু শহরের মেয়র ইয়ুতাকা কুমাগাই।

স্টেডিয়াম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন মেয়র ইয়ুতাকা কুমাগাই। এরপরই কাচের ছোট আধারের ভেতরে পাথরের গুঁড়ার মধ্যে রাখা একটি ফুল দেখিয়ে সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি অলিম্পিক উপলক্ষে মিয়াগিতে আসতে যাওয়া অতিথিদের উদ্দেশে ছোট শিশু জুরি সাতোর লেখা একটি চিঠি সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন ইয়ুতাকা কুমাগাই। চিঠিতে সেই ফুল সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। জুরি সাতো চিঠিতে লিখেছে:

আইরির ফুল দিয়ে তৈরি পদক দেখাচ্ছেন রিফু টাউনের মেয়র ইয়ুতাকা কুমাগাই। ছবি: মনজুরুল হক
আইরির ফুল দিয়ে তৈরি পদক দেখাচ্ছেন রিফু টাউনের মেয়র ইয়ুতাকা কুমাগাই। ছবি: মনজুরুল হক

‘আমার বড় বোন আইরির কথা আপনাদের আমি বলতে চাই। আট বছর আগের পূর্ব জাপান ভূমিকম্পে আমার সেই বোনটি প্রাণ হারায়। বলা হয় যে সেই ভূমিকম্প ছিল বিশ্বের ইতিহাসে চতুর্থ বৃহত্তম ভূমিকম্প। আমার বোনের মৃতদেহ যেখানে খুঁজে পাওয়া যায়, সেখানে সাদা একটি ফুল ফুটে ছিল। আমি সেই ফুলের চারাটি তুলে এনে বাড়িতে পুঁতে রেখেছি, যদিও ফুলটি তখন প্রায় ঝরে পড়া অবস্থায় ছিল। তবে সেদিন থেকে প্রাণ ফিরে পাওয়া সেই ফুল এখন অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। আপনারা প্রত্যেকে যেন সেই ফুলের কথা জানতে পারেন আর মানুষ যেন পূর্ব জাপানের ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এর কারণের দিকেও ফিরে তাকাতে পারেন, সেই কামনা আমি করছি। আমি আশা করছি, ভবিষ্যতের দুর্যোগ প্রতিরোধ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা এবং জীবনের অর্থ বুঝে উঠতে পারার সুযোগ সারা বিশ্বের সবার জন্য এই ফুল করে দেবে। আগামীর ভূমিকম্প কখন এবং কোথায় ঘটে যেতে পারে, তা আমাদের কারও জানা নেই। ফলে জীবন কতটা মূল্যবান, এই ফুলের মধ্য দিয়ে তা আমি ভাবতে চাই। ২০২০ সালে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন আমরা করব। আমার ইচ্ছা, বিশ্বের সব মানুষ যেন এই ফুলের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন এবং জীবনের অর্থ সম্পর্কে ভাবেন।’

ছোট শিশুটি লিখেছে, ‘আমার বড় বোনের নামে এই ফুলের নাম রাখা হয়েছে আইরি। বিশ্বের সব মানুষ এই ফুলকে স্মরণ করে মূল্যবান জীবনের প্রতীক হিসেবে এটাকে ব্যবহার করুক, এটুকুই কেবল আমার কামনা। আর তাই আমার বড় বোনের ফুল আইরির কথা যেন বিশ্বের সবার কাছে পৌঁছে যায়, সেই কাজে অনুগ্রহ করে আমাকে সাহায্য করুন।’

রিফু টাউনের মিয়াগি স্টেডিয়াম। ছবি: মনজুরুল হক
রিফু টাউনের মিয়াগি স্টেডিয়াম। ছবি: মনজুরুল হক

এ রকম ছোট ছোট আবেগ, হঠাৎ পেয়ে যাওয়া কোনো সাফল্য গভীর সংকটের মুখেও মানুষকে কীভাবে উদ্দীপ্ত করে পারে, তার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসেবে মেয়র কুমাগাই জাপানের জাতীয় নারী ফুটবল দলের ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জেতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। সুনামি আর ভূমিকম্পেই কেবল জাপান তখন বিধ্বস্ত হয়নি, একই সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনাও নিয়ে এসেছিল ভয়ংকর বিপর্যয়। সে রকম এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে জাপানের নারী ফুটবল দল যে বিশ্বকাপের ফাইনালে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে শিরোপা জিতে নেবে, সেদিন কেউ তা কল্পনা করতে পারেনি। তবে জাপানি তরুণীদের দৃঢ় মনোবল সব রকম প্রতিকূলতা পার হয়ে বিজয়ী হয়েছিল এবং সেই জয়ের মধ্যে দিয়ে হতোদ্যম মানুষের মনে আশার নতুন আলো সেই তরুণীরা সেদিন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

জাপানের জাতীয় নারী ফুটবল দলটি এরপর থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে নাদেশিকো নামে, যে ফুল হচ্ছে কঠিন পরিবেশে কোনো রকম যত্ন ছাড়াই এর রং ছড়িয়ে দেওয়া এক বুনোফুল। মেয়র মনে করেন, সুনামি আর ভূমিকম্পের হাত থেকে প্রাণে নিজে বেঁচে না গেলেও আইরির মৃতদেহের পাশে ওর ছোট বোনের খুঁজে পাওয়া ফুলও অনেকটা যেন নাদেশিকোর মতোই নতুন আশার কথা আমাদের শোনায়, আশার যে পথ ধরে জাপানের দুর্যোগে আঘাত হানা এলাকাগুলো পুনরুদ্ধারের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।