দিনে ১২৯ ফৌজদারি মামলা

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নতুন বার্ষিক প্রতিবেদনটি হাতে নিয়ে প্রথমেই দেখে নিই ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ২০১৮ সালে হাইকোর্টে মোট কতটি বেড়েছে। কারণ, গত সাধারণ নির্বাচনের আগে আমরা ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছিলাম, শান্ত ঢাকায় এক মাসেই ৫৭৮টি নাশকতার (কারও মতে সিংহভাগ গায়েবি) মামলা হয়েছিল। তাই নজর রাখছিলাম সুপ্রিম কোর্টের ২০১৮ সালের রিপোর্ট থেকে ফেলে আসা নির্বাচনী বছরটিতে ফৌজদারি মামলার সংখ্যাধিক্যের একটা যুক্তিসংগত আন্দাজ করা যায় কি না।

২০১৮ সালেই বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি মামলা এসেছে ও জমেছে হাইকোর্টে। নতুন মামলা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৫টি। বিচারাধীন মামলার মোট সংখ্যা এখন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৩৩৫। ইতিহাসে এই প্রথম হাইকোর্টে ফৌজদারি মামলায় তিন লাখ সংখ্যাটি ছাড়াল।

বাহাত্তরে আমাদের জনসংখ্যা যখন সাড়ে ৭ কোটি ছিল, তখন হাইকোর্টে ফৌজদারি মামলা ছিল ২ হাজার ৯১৯টি। এখন জনসংখ্যা আড়াই গুণ, বেড়ে ১৭ কোটি হয়েছে। কিন্তু অপরাধবিষয়ক মামলা হাইকোর্টেই বেড়েছে ১১২ গুণের বেশি। যাঁরা জিডিপির গল্প শোনান, তাঁদের একই সঙ্গে এই গল্পটাও জানা দরকার।

বাহাত্তর-পরবর্তী প্রথম দশকে আড়াই হাজার থেকে ছয় হাজার ফৌজদারি মামলা ওঠানামা করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে যথাক্রমে ৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার এবং ২১ হাজার থেকে ৬০ হাজার থেকে ক্রমাগত বেড়েছে। চতুর্থ দশকেই (২০০২-১১) ৭২ হাজার থেকে দেড় লাখে দাঁড়ায়। আর পরের ৭ বছরেই (২০১২-১৮) সংখ্যাটি ১ লাখ ৬০ হাজারে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে এখন তা ৩ লাখ ৩০ হাজার ছুঁইছুঁই। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে গত ৭ বছরে সামাজিক অপরাধের মাত্রা ভয়ানক তীব্রতা পেয়েছে। এই সময়েই দেশে দুটি বড় ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে।

তবে দেখার বিষয় হলো আমরা কী করে মামলাজট কমাব। আপিল বিভাগে মামলাজট থাকলেও হাইকোর্ট বিভাগের মতো অতটা ব্যাপক নয়। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে গণপরিষদের বক্তৃতায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ৯০ ভাগ মানুষ আসবে হাইকোর্টে। ১০ ভাগ যাবে আপিল বিভাগে। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যার অনুপাতে মামলার সংখ্যা কত? ওপরে আমরা দেখলাম যে সাত বছরের ব্যবধানে হাইকোর্টে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলো। কিন্তু পরিহাস হলো হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়া দূরে থাক, ১০১ জন থেকে হ্রাস পেয়ে ৯৫ জনে দাঁড়ায়। সম্প্রতি তিনজন বিশেষ ছুটিতে যাওয়ার কারণে এখন সংখ্যা ৯২। ২০১৮ সালে ৯৫ জন বিচারপতি মোট ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ৩১ হাজার ৯২৩টি। মাথাপিছু মামলা নিষ্পত্তির হার ৩৩৬। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলের ৫ বছরে গড়ে হাইকোর্টে বিচারপতি ছিলেন প্রায় ৩৭ জন। তাঁরা ওই ৫ বছরে ২৯ হাজার ৬২৬টি ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। বিচারপতিদের মাথাপিছু মামলা নিষ্পত্তির গড় হার ছিল ৮০৫। সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে বিচারপতিদের সংখ্যা বাড়ালেই মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ে না।

কিন্তু আমরা কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে অপারগ। কী কারণে এতটা বৈপরীত্য, তার ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদনে পাওয়া যায় না। আমরা অবশ্য এ প্রসঙ্গে জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাইড এবং জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড—দুটোই স্মরণ করতে পারি।

১৯৭২ থেকে পরের ৩৭ বছরে হাইকোর্টের সব বিচারপতি মিলেও কোনো একটি বছরে কখনোই ১৫ হাজারের বেশি ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করেননি। কিন্তু ২০১০ ও ২০১১ সাল ব্যতিক্রম। এই দুই বছরে প্রথমবারের মতো অতীতের রেকর্ড ভেঙে হাইকোর্ট যথাক্রমে ৫৬ হাজার ও ৫২ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেন। এতে দুই বছরে ৯৩ জন বিচারপতি গড়ে ১ হাজার ১৭০টি করে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম ৫ বছরে হাইকোর্টের ৯৩ জন বিচারপতি দেড় লাখ ও দ্বিতীয় মেয়াদে ১ লাখ ৪ হাজার ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করেন। এতে মাথাপিছু নিষ্পত্তির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৬৫০ এবং ১ হাজার ১২১। এই হিসাবে হাইকোর্টের বিচারপতিরা গত পাঁচ বছরে সরকারের আগের মেয়াদের তুলনায় গড়ে ৫২৮টি করে মামলা কম নিষ্পত্তি করেছেন। আবার ২০১৮ সালে মোট ফৌজদারি মামলা যেখানে প্রায় ৫০ হাজার নিষ্পত্তি হলো, সেখানে প্রায় ৮৯ হাজার একদম নতুন ফৌজদারি মামলা করা হলো। এই যে একটি বছরেই ৩৯ হাজার মামলায় পিছিয়ে থাকা, এর প্রতিকার কী? বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ওপর সব রকম মামলা মিলিয়ে পাঁচ লাখের বেশি মামলার পাহাড়।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রিপোর্টে এবার একটি বিরল দলিল ছাপা হয়েছে। ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিপত্র অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্ট অব জুডিকেচারের বিচারপতিরা তাঁদের গাড়িতে পতাকা ব্যবহার শুরু করেন। প্রতিবেদনটি উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা গাড়িতে পতাকা যুক্ত করতে গিয়ে সেখানে একটি নতুন শব্দ যুক্ত করেন। আর সেটি হলো জাস্টিস বা ন্যায়বিচার। দাঁড়িপাল্লা হলো ‘রুল অব ল’, যা প্রতিষ্ঠা করতে বিচারপতিরা শপথবদ্ধ। কিন্তু দেশে গত কয়েক বছরে যত ‘আইন’ পাস হয়েছে, তার অনেকটাই কালো আইন। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার এক গোলটেবিলের আয়োজন করেছিল গত শনিবার মানহানি মামলার ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে। সেখানে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বক্তা একমত হন যে আইন এখন এমনই যে তা ব্যবহার করা মানেই অপব্যবহার। আমরা উদ্বিগ্ন যে মামলার বোঝা কমবে কীভাবে। দেশে গায়েবি মামলা, হয়রানিমূলক মামলা, মিথ্যা মামলা, আরও কত শত মামলার প্রজননকেন্দ্রগুলো যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে কী করে এত মামলার বোঝা নিয়ে হাইকোর্ট কিংবা আপিল বিভাগ, যার ৭ বিচারপতির ওপর সাড়ে ২০ হাজার মামলা (সেখানেও গত বছর সাড়ে ৬ হাজার নিষ্পত্তি হলো তো সাড়ে ১০ হাজার ঢুকল), কীভাবে ‘ন্যায়বিচার’ দেবেন?

সুপ্রিম কোর্টের রিপোর্টেই চোখ পড়ল আমাদের হাইকোর্টের সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের নাড়ির সম্পর্ক, সেই ১৭২৬ সালে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জর্জের আমল থেকে। সাতচল্লিশে কলকাতা হাইকোর্টের নথিপত্রের সঙ্গে আসবাব ভাগ হয়েছিল। কিছু চেয়ার-টেবিল, ঘড়ি সুপ্রিম কোর্টে এখনো রক্ষিত আছে। হঠাৎ মনে হলো, কলকাতা হাইকোর্টে ফৌজদারি মামলার চাপটা কেমন জেনে দেখি।

পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা এখন ৯ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ধারণা করেছিলাম, মমতার রাজত্বে ফৌজদারি মামলা আর কতই–বা কম হবে। সেখানেও তো দাঙ্গা–হাঙ্গামা লেগে থাকে। সমাজের পচন তো সেখানেও ধরেছে। কিন্তু যা জানলাম, তার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না।

কলকাতা হাইকোর্টের অরিজিনাল সাইডে ফৌজদারি মামলার ঘর শূন্য। অ্যাপিলেট সাইডে মোট বিচারাধীন মামলা (৩০ জুন ২০১৯ পর্যন্ত) ২ লাখ ৮ হাজার ৬৪০। মোট ৪১ জন বিচারপতি। এই মুহূর্তে তাঁদের বিচারাধীন দেওয়ানি মামলা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এটা কিন্তু আমাদের থেকে ৭০ হাজার বেশি।

অথচ মোট ফৌজদারি মামলা ৪০ হাজারের কম, এ রকম ফৌজদারি মামলার সংখ্যা আমাদের এখানে ১৯৯৮ সালে ছিল। গত জুন মাসে হাইকোর্টে নতুন ফৌজদারি মামলা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৫৮টি, নিষ্পত্তি ১ হাজার ৩৩২। তার মানে বিচারাধীন থাকার ব্যবধান মাত্র ২৬টি। মাথাপিছু নিষ্পত্তির হার মাসে ৩২, বছরে ৩৮৯। সেই তুলনায় আমাদের বিচারপতিদের গতি সুপারসনিক। অবশ্য এদিক থেকে বলা যায়, কলকাতার বিচারপতিদের চেয়ে ঢাকার বিচারপতিদের চাপ বেশি, মাইনে কম।

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনটির মুখবন্ধে যা লিখেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘প্রতিটি সভ্য সমাজ একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে।...ক্ষমতার পৃথক্‌করণ মতবাদ মনে রেখে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগকে যথেষ্ট সংযম দেখাতে হয়। যথাযথভাবে বিচার প্রশাসন পরিচালনা সংবিধানের অন্যতম লক্ষ্য, যাকে অবশ্যই সামাজিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।...তবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিচার বিভাগের অগ্রগতি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। যেকোনো আইনের অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ রোধে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক ব্যারন ডি মন্টেস্কু একদা বলেছিলেন, যে স্বৈরতন্ত্র আইনের ছত্রচ্ছায়ায় ও আইনের নামে চলে, তার থেকে নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্র আর হয় না।’

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক