'বিদেশিদের শেখানো বুলি' আর সাংসদদের বয়ান

অলংকরণ তুলি
অলংকরণ তুলি

জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে টিআইবি বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে একহাত নিয়েছেন। অনুষ্ঠানটি ছিল শিশু অধিকার-সংক্রান্ত। কিন্তু জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে আসা এই আইনপ্রণেতা তাঁর বক্তৃতায় টিআইবি নিয়েই বেশি কথা বলেছেন।

টিআই বা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে। আওয়ামী লীগের নেতারা যে কথায় কথায় বিএনপিকে পরপর চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করে থাকেন, সেই রিপোর্টও তৈরি করেছিল টিআই। এরই বাংলাদেশ চ্যাপটার হলো টিআইবি। সরকারের অনুমতি নিয়েই টিআইবি এখানে কাজ করছে।

যখন রিপোর্ট অন্যের বিপক্ষে যাবে, তখন সেটিকে সাধুবাদ জানানো হবে, আর নিজের বিপক্ষে গেলে বিদেশিদের শেখানো বুলি বলে গালমন্দ করা হবে, এটি কেবল স্ববিরোধী নয়, অনৈতিকও। ফজলে রাব্বী মিয়াদের অবগতির জন্য বলছি, টিআইয়ের রিপোর্টে একবার আওয়ামী লীগ সরকারও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এবং সেটা বিএনপির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই। আর তিনি যেই নেতার হাত ধরে প্রথমে সংসদে এসেছিলেন, সেই এরশাদ সাহেব কী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তা পুনরুল্লেখ করতে চাই না।

ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছেন, ‘টিআইবি বিদেশিদের শেখানো বুলি আওড়ায়। ...উনারা উনাদের মতো করে কথা বলেন। উনাদের সম্পর্কে আমরা যদি বলি তাহলে তো তাদের মাথায় হাত পড়বে। বিদেশিরা যেভাবে শিখিয়ে দেয়, তারা (টিআইবি) সেভাবে তা আওড়ায়। আমরা সেভাবে করি না। শীতাতপ কক্ষে বসে কত টাকা বেতন নেন? আমরা শীতাতপ কক্ষে বসে আইন পাস করি। এটা কারও দয়ার টাকা নিয়ে নয়। জনগণের টাকায়, তাঁদের রায় নিয়ে।’

টিআইবি সম্পর্কে ডেপুটি স্পিকারের বক্তব্যে আমরা বেশ কিছু ইঙ্গিত পেলাম। প্রথমে তিনি টিআইবিকে সাবধান করে দিয়েছেন, তারা যেন বাড়াবাড়ি না করে। তাহলে তাদের মাথায় হাত পড়বে। এর অর্থ হলো, তোমরাও আমাদের সম্পর্কে কিছু বলো না, আমরাও বলব না। অর্থাৎ সমঝোতামূলক সন্ধি চাইছেন ডেপুটি স্পিকার। দুই. তোমাদের সম্পর্কে সাংসদদের কাছে এমন তথ্য আছে, যা প্রকাশ করলে তোমাদের বিপদ হবে। তিন. তোমরা বিদেশিদের টাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসো। আমরাও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসি, তবে সেটি বিদেশি টাকায় নয়, জনগণের টাকায় এবং জনগণের রায় নিয়ে।

ফজলে রাব্বী মিয়ার শেষ কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি শেষ বক্তব্যটি অর্থাৎ ‘জনগণের রায় নিয়ে আমরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আইন পাস করি’ বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদটির কথাই মনে পড়ে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’ যাঁরা জনগণের ভোট নিয়ে সংসদে যান, তাঁদের প্রতিদিন হলফ করে বলতে হয় না, আমরা তাঁদের রায় নিয়ে এসেছি। জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছেন ইত্যাদি।

আসলে টিআইবির ওপর ফজলে রাব্বী সাহেবদের গোসসার কারণ হলো সংস্থাটি গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের গুমর ফাঁস করে দিয়েছে। টিআইবি নির্বাচনের পর ৫০টি আসনে জরিপ করে দেখেছে, সেসব আসনে ব্যালট পেপারে রাতে সিল মারা থেকে শুরু করে এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও টিআইবির সেই জরিপের প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি। আর যদি ফজলে রাব্বী মিয়াদের এতই সাহস থাকে, তাঁরা টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে সংসদে একদিন আলোচনা করতে পারেন। সংসদের বাইরে টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে কথা বলছেন কেন? এর আগেও টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

ফজলে রাব্বী মিয়া টিআইবির যে জরিপের কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি ছিল জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা সংক্রান্ত। তবে বর্তমান সংসদের নয়, দশম সংসদের। সেই সংসদেও তিনি ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। ফলে কোন বিল কত মিনিটে পাস হয়েছে, সেই তথ্য দেশবাসী টিআইবির মাধ্যমে জেনে গেলে তাঁর ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ আছে বৈকি। কিন্তু ফজলে রাব্বী মিয়া টিআইবির জরিপে দেওয়া কোনো তথ্য খণ্ডন করেননি। টিআইবি বলেছে, কোরাম-সংকটের কারণে দশম জাতীয় সংসদে ১৬৩ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে এবং সেটি বিদেশ থেকে পাওয়া নয়, জনগণের করের টাকা। জনগণের করের টাকা কীভাবে খরচ হলো, কোথায় অপচয় হলো, সেটি জানার অধিকার নিশ্চয়ই করদাতাদের আছে।

টিআইবি সাংসদদের এখতিয়ার বা অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করেনি। প্রশ্ন করেছে আইন প্রণয়নের সময় নিয়ে। গড়ে প্রতিটি আইন প্রণয়ন করতে মাত্র ৩১ মিনিট ব্যয় করা হয়েছে। অথচ আইন প্রণয়নই সাংসদদের প্রধান কাজ। দশম জাতীয় সংসদের একজন সদস্য একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে পলাতক ছিলেন, সেই অবস্থায় সংসদে এসে হাজিরা খাতায় সই দিয়ে নিজের সদস্যপদ রক্ষা করেছেন এবং অধিবেশনে উপস্থিত না থেকে ভাতাও নিয়েছেন। ওই সংসদের ডেপুটি স্পিকার হিসেবে ফজলে রাব্বী মিয়া তাঁর এই অনৈতিক কাজ ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। অতএব, টিআইবি বা অন্য কেউ এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে সেটি বিদেশিদের শেখানো বুলি বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সুযোগ নেই।

ডেপুটি স্পিকার যখন সরকার ও সংসদকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে টিআইবির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তখন সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ ফজলুর রহমান কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতি এখন হাস্যরসের বিষয় হয়ে গেছে। ৫ হাজার ৫০০ টাকার বই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিনেছে ৮৫ হাজার ৫ টাকায়। পুকুর খনন শিখতে বিদেশ যাবেন ১৬ জন কর্মকর্তা। এ জন্য ব্যয় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। রূপপুরের বালিশকে তোশকের নিচে নিয়ে গেছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনার ঘটনা। (প্রথম আলা, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)

ফজলুর রহমান যেদিন দুর্নীতির এই বয়ান জাতীয় সংসদে দিয়েছেন, সেদিনও বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দুর্নীতির খবর শিরোনাম হয়েছে। ফজলে রাব্বী মিয়ারা কি বলবেন সাংসদ পীর ফজলুর রহমানের কথাও বিদেশিদের শেখানো বুলি?

ফজলে রাব্বী মিয়ারা আসলে টিআইবির রিপোর্টকে বিদেশিদের শেখানো বুলি বলে তাদের মুখ বন্ধ করতে চান। কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের মুখ কী করে বন্ধ করবেন? রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বন্দরে তাঁরা কী বলেন, জানার চেষ্টা করুন।

আসলে টিআইবি বা গণমাধ্যমে দুর্নীতির যেসব চিত্র উঠে এসেছে, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়েও ভয়াবহ। সরকারি দলের সাংসদেরা সংসদে মনের মাধুরী মিশিয়ে যা-ই বলুন না কেন, তাতে সত্যকে আড়াল করতে পারবেন না। সত্য প্রকাশ পাবেই।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।
[email protected]