যাঁরা সব দিলেন, আজ তাঁদের পাওয়ার পালা

ঝিনাইদহ কেসি (কেশবচন্দ্র) কলেজ কম্পাউন্ডের মধ্যে ওই কলেজেরই শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ই আমার প্রথম বিদ্যাপীঠ। ১৯৮১ সালে সেই বিদ্যালয়ে ‘কেজি’ শ্রেণিতে (আমরা বলতাম ‘ছোট ওয়ান’) ভর্তি হলাম। বেশি দিন পড়িনি, তবে একটি ঘটনা মনে পড়ে। একদিন অঙ্ক ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে আমরা খুব হইচই করছিলাম। প্রধান শিক্ষক (তিনি সম্ভবত মূলত কলেজের শিক্ষক ছিলেন) এসে আমাদের ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত লিখতে বললেন। কিন্তু আমাদের লেখা শেষ হওয়ার আগেই তিনি অন্য ক্লাসে চলে যান। আমি লেখা শেষ করে স্যারকে অন্য একটি শ্রেণির ক্লাসে খুঁজে পেলাম। সেই ক্লাসে ঢুকে স্যারকে আমার খাতা দিলাম। স্যার আমার হাত থেকে পেনসিলটা নিয়ে বড় করে ‘১০০ তে ১০০’ লিখে দিলেন। স্যারের নাম মনে নেই। চেহারাও মনে নেই (সম্ভবত চশমা পরতেন)। কিন্তু সেই ‘১০০ তে ১০০’ আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে গেল! 

এরপর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ প্রাঙ্গণের শিশুকুঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি (মধ্যে ক্লাস ফোর এবং ফাইভে ছয় মাস কুমিল্লা ইস্পাহানি স্কুলে)। এই স্কুলে রয়েছে আমার অনেক সুখস্মৃতি। অঙ্কের শাহজাহান স্যার, ইংরেজির গৌতম স্যার, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিসট্রেস ইসলাম ম্যাডামসহ শিক্ষকদের অনেক স্নেহ, ভালোবাসা ও আদর পেয়েছি। 

ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার সময় আক্কাস স্যার আমাদের অনেক যত্ন করে কোচিং করাতেন। ছুটির দিনে শিঙাড়া অথবা জিলাপি কিনে আনতেন। নিয়ম ছিল রাত ১০টা পর্যন্ত বাসায় পড়াশোনা করার। শীতের রাতে রাত ১০টা পর্যন্ত পড়া ছিল অনেক কষ্টের। কিন্তু মাঝেমধ্যেই স্যার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতেন। 

১৯৮৮ সালে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। পড়ানো ছাড়াও সেখানকার শিক্ষকদের সারা দিনই ক্যাডেটদের বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করা লাগে, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী তুমুল মেধাবী ৩০০ কিশোরের অভিনব সব দুষ্টুমিও সামলাতে হয়। তাই ক্যাডেটদের সঙ্গে শিক্ষকদের অম্লমধুর সম্পর্ক। ৩০-৪০ বছর পরে দেখা হলেও তাঁরা আমাদের ঠিকই চিনতে পারেন। 

ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে নুরুল ইসলাম স্যারের কথা। অসম্ভব অনাড়ম্বর, নিরাসক্ত, জ্ঞানী আর তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এই অঙ্কের শিক্ষক। কিন্তু সমাজ, ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য—সব বিষয়ে স্যারের ছিল অসম্ভব পাণ্ডিত্য। শেক্‌সপিয়ারের হ্যামলেট থেকে গড়গড় করে আওড়াতেন। সম্ভবত আমরা ক্লাস টেনে পড়ার সময় স্যার অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি নিজের জীবনের স্মৃতি আর জীবনচেতনা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন, যা আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। স্যার অবসরের পরে ঝিনাইদহ থাকতেন। স্যারের সঙ্গে দেখা করার কথা ভেবেও কেন জানি হয়ে ওঠেনি। স্যার এখন নেই। আক্ষেপ হয় কেন কোনো খোঁজ রাখিনি। 

ক্যাডেট কলেজের কঠোর রুক্ষ জীবনের মধ্যে নাজনীন করিম ম্যাডাম ছিলেন স্নিগ্ধ বৃষ্টির পরশের মতো। যত কিছু আবদার আমরা ম্যাডামের কাছেই করতাম। অসম্ভব স্নেহময়ী ম্যাডাম ছিলেন বড় বোনের মতো। সবার জন্য ওনার ছিল অসম্ভব মমতা। ভূগোলের শিক্ষক বলে এসএসসির পর আর ম্যাডামের ক্লাস পাইনি। কিন্তু যখনই দেখা হতো, কেমন আছি জিজ্ঞেস করতেন। গ্রীষ্মকালে আফটার নুন প্রেপ (নিজস্ব পাঠ প্রস্তুতির সময়) ছিল ক্যাডেট জীবনের এক বিভীষিকা। দুপুরের খাবারের পর একটু বিশ্রামের সময় যখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত, তখনই আফটার নুন প্রেপের ঘণ্টা বাজত। কাঁচা ঘুম ভেঙে ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে আমরা একাডেমি ব্লকের দিকে ছুটতাম। আফটার নুন প্রেপে বসে কখনো ঘুমায়নি, এমন ক্যাডেট বিরল। নাজনীন ম্যাডাম গার্ড হিসেবে এলে সাধারণত ক্লাসে ঢুকে ডায়াসে দাঁড়িয়ে অথবা কোনো খালি ডেস্ক থাকলে সেখানে বসে বই অথবা পত্রিকা পড়তেন। আমরা ঘুমালেও তেমন কিছু বলতেন না। বড়জোর স্নেহভরে ডেকে জাগিয়ে দিতেন। এমনকি আমাদের অনুরোধে প্রায়ই তাঁকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে হতো, যাতে প্রিন্সিপাল স্যার রাউন্ডে এলে আমাদের আগেই সাবধান করে দিতে পারেন। ক্যাডেট কলেজের মতো একটি জায়গায় এমন স্নেহশীলতা দেখানো শুধু নাজনীন ম্যাডামের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ক্যাডেট কলেজের পর অন্য কলেজে যাওয়ার পরও আমাদের খবর ঠিকই রাখতেন, হলে একই স্নেহ আর আন্তরিকতায় গল্প করতেন। কয়েক বছর আগে ম্যাডামের হঠাৎ চলে যাওয়ার খবরে আমরা কেঁদেছি। 

শাহিদা ম্যাডাম, ফজলুল করিম স্যার, আতিক স্যার, রতন স্যার, আশীষ স্যার, হাসানুজ্জামান স্যারসহ ক্যাডেট কলেজের সব শিক্ষকের কাছেই আমরা চিরকৃতজ্ঞ তাঁদের স্নেহ, পরামর্শ আর ভালোবাসার জন্য। এখনো কলেজের অনেক শিক্ষক ফোন করেন। পত্রিকায় আমার কোনো ছবি দেখলে কিংবা খবর পড়লে অনেক খুশি হন। কিছুদিন আগে হালিমা ম্যাডাম ফোন করলেন। হালিমা ম্যাডাম ও রওশন স্যার দুজনই আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। রওশন স্যার কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন। হালিমা ম্যাডাম এখন ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁরা একটা হোম লোন নেওয়ার জন্য আইপিডিসির তরুণ রিলেশনশিপ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন আর আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজারকে বলেছেন। শাখা ম্যানেজার আমাকে জানানোর কিছুক্ষণ পরে রিলেশনশিপ ম্যানেজার আমার মোবাইলে ফোন করে ভয়ে ভয়ে বলছে, ‘স্যার, আপনার ক্যাডেট কলেজের টিচার হালিমা ম্যাডাম হোম লোনের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।’ আর ওই দিকে ম্যাডাম বলছেন, ‘আরে তুমি ফোনটা আমার কাছে দাও না। আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলব।’ আমি বললাম, ‘ম্যাডামকে ফোন দাও।’ ম্যাডাম ফোন হাতে নিয়েই বললেন, ‘বাবা মমিন, কেমন আছ?’ ঠিক যেন আমার মায়ের কণ্ঠস্বর! 

আমাদের শৈশব আর কৈশোরের প্রিয় শিক্ষকেরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। অনেকেই আছেন আর্থিক কিংবা শারীরিক দুরবস্থার মধ্যে। আমাদের মা-বাবার মতোই এসব শিক্ষক আমাদের মায়া-মমতায় আগলে রেখে আমাদের দিয়েছেন ভবিষ্যতের পথচলার পাথেয়। নিঃস্বার্থভাবে বপন করেছেন আমাদের আজকের সাফল্যের বীজ। 

এবার সময় ফিরে তাকানোর। এই সব অসামান্য দেশ গড়ার কারিগরের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার। আইপিডিসি আর প্রথম আলো মিলে আয়োজন করেছে এই সব শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়ার। আপনিও যোগ দিন এই প্রয়াসে। 

মমিনুল ইসলাম: আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা