রোল মডেলের দেশে এ কোন মডেল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি শুধু উপমহাদেশেই ছিল না, এশিয়ার বাইরে অন্য মহাদেশেও ছিল বিস্তৃত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অন্য মহাদেশের শিক্ষার্থীরাও আসতেন এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যা অর্জন করতে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে উগান্ডা থেকে সরকারি বৃত্তি নিয়ে এসেছিলেন আজিজ কালুঙ্গি কাসুজা ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। তিনি ছিলেন আমার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবাসিক ছাত্র ছিলেন প্রথমে ঢাকা কলেজের নর্থ হোস্টেলে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে, এখন যার নাম স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল। ফিলিপ জে হার্টগ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। তিনি ছিলেন বিশ্বপরিচিত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাগবেষক। 

আজিজ কাসুজা ছিলেন উগান্ডার সামরিক একনায়ক ইদি আমিনের মতো দেখতে এবং খুবই লম্বা-চওড়া। খুবই শান্ত, নম্র প্রকৃতির, মনোযোগী ছাত্র, আমার মতো অমনোযোগী নন। ছয়টি বছর তাঁকে দেখেছি। নীতিমান মানুষ। দেশে গিয়ে বড় বড় পদে ছিলেন। একপর্যায়ে হয়েছিলেন উগান্ডার প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তাঁর নামের একাংশের নামে আমাদের একজন সিইসি দুর্নাম নিয়ে চলে যান; আমার সহপাঠী উগান্ডার আজিজ প্রশংসিত হয়েছিলেন বলে খবর পেয়েছি। ভোটারবিহীন নির্বাচন তো দূরের কথা, কারচুপি করার সুযোগ দেননি কোনো প্রার্থীকে। 

শুধু আজিজ কাসুজা নন, ষাটের দশকে আমাদের সহপাঠী ছিলেন নিয়াসাল্যান্ডের (মালাবি) জেয়ফ্রে উইলিয়াম লুঙ্গু, মালয়েশিয়ার সৈয়দ সামাহ আলী নুরসহ আরও অনেকে। নিজ নিজ দেশে গিয়ে তাঁরা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হন। ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে তাঁরা কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বিভিন্ন দেশে উচ্চারিত হয় একটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। 

লন্ডনভিত্তিক উচ্চশিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে জরিপ করে। এবার তারা ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি জরিপ করেছে। তাতে বাংলাদেশের রোল নম্বর সেরা এক হাজারের মধ্যে নেই। আজিজ, নুর, লুঙ্গু বেঁচে আছেন কি না জানি না, যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে এই জরিপের ফলাফল দেখে ভীষণ আহত হয়েছেন। বিশেষ করে তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের আর অহংকার করে বলার মতো কিছু থাকল না। ‘আমার বাবা, আমার দাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’—এ কথা এখন তারা বললে তাদের বন্ধুবান্ধব বলবে, ‘কী বলিস? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? নাম তো জানি না। সেটা কোথায়?’ তারা বলতে পারবে না, ‘সেটা রোল মডেলের দেশে।’ 

দুনিয়ায় রোল মডেল নয় যেসব দেশ, সেগুলোর মধ্যে সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের ৩৬টি, পাকিস্তানের ৭টি ও শ্রীলঙ্কার ১টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রোথ, প্রবৃদ্ধি, রোল মডেল শব্দগুলো শুনতে শুনতে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এই গ্রহের দুর্নীতিপরায়ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষে, সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের নামগন্ধ না থাকা বিশেষ অসংগতিপূর্ণ, তা বলা যাবে না। দুই তালিকার একটির সঙ্গে আরেকটির গভীর সম্পর্ক। প্রথমটির তালিকায় যদি নাম না থাকত, তাহলে দ্বিতীয়টির তালিকায় প্রথম দু-এক শর মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠত। 

দুনিয়ার কথা বাদ দিলাম। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের আর কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান কোথায়? এ বছর মে মাসে টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায়ও এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও উল্লেখ ছিল না। ওই তালিকা বেরোনোর পর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট কারও টনক নড়া তো দূরের কথা, একটি লোমও নড়েনি। বরং তাঁরা স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে বলে থাকবেন: তোরা যে যা বলিস ভাই,/জ্ঞানচর্চা ছাই,/আমার নিয়োগ-টেন্ডার–বাণিজ্য চাই। 

মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশের নাম বিশ্ব রেকর্ডে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যে হারে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে আগামী এক দশকে চিকিৎসাসেবার মতো উচ্চশিক্ষাও বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ‘দোরগোড়ায়’ পৌঁছে যাবে। গ্রামগুলো ভরে যাবে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’। জায়গার অভাবে তাই নতুন অবকাঠামো করা সম্ভব না হলে বিদ্যমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেই তড়িঘড়ি করে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হবে। শিক্ষক পাওয়া যাবে না, কুচ পরোয়া নেই, হাইস্কুলের শিক্ষকদেরই অনেকে পার্টটাইম অধ্যাপনার চাকরি পাবেন। ক্লাস নেবেন অনার্স ও মাস্টার্সের। তাতে ছাত্রছাত্রীদের সনদপ্রাপ্তিতে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটবে না। 

এই সব জরিপ-টরিপ যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত-শিবির অথবা তোপখানা রোডের সরকার-সমালোচক বাম দলের কেউ যুক্ত আছেন কি না, সে অভিযোগ এখনো প্রকাশ্যে কেউ করেননি। সম্ভবত না করার কারণ ওই সব জরিপকে দুপয়সা দাম দেয় না সরকার। এ রকম জরিপ যে শুধু এবারই হয়েছে, তা নয়। হরবছরই হয় এবং বহু বছর যাবৎ ফলাফল কমবেশি এ রকমই হয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত আমরা দেখিনি এ ধরনের জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আত্মপর্যালোচনার জন্য বৈঠক করেছে। কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না এবং থাকলেও তলানিতে, তা পর্যালোচনা করে আত্মোন্নতির ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উন্নত শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা ছাড়াও পরিবেশ ধ্বংস করে জিডিপি ডাবল ডিজিট বা ১০-এর ঘরে যেতে পারে, তবে অর্ধশিক্ষিত জাতি থাকবে অধঃপতিত। 

পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়: শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও মান, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, গবেষণা থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা। এর সব কটির র‍্যাঙ্কিংয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে আছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বাধীন জ্ঞানচর্চার পরিবেশ যে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বাজারের পাস্তুরিত দুধের গবেষণা নিয়ে বিতর্ক। সংশ্লিষ্ট গবেষককে হুমকি-ধমকি দিতে কর্তৃপক্ষের বিবেকে বাধেনি। আমাদের রাষ্ট্র নষ্ট রাজনীতি ও দূষিত গণতন্ত্রের যন্ত্রণা সইতে জনগণকে বাধ্য করছে, অন্যদিকে সে মানুষকে দূষিত দুধ খেতে বাধ্য করতেও দ্বিধা করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হতো, সরকার শিক্ষকদের গবেষণাকাজে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারত না। প্রথম ৫০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা অধিকাংশই বিশ্বমানের গবেষণা করেছেন। 

প্রতিবছর যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তাঁদের গড় সহজাত মেধা উন্নত দেশের ছেলেমেয়েদের মতোই। কেউ কেউ অত্যন্ত মেধাবী। শিক্ষকদের একটি বড় অংশের যোগ্যতা, নিষ্ঠা, নৈতিক মান নিয়ে মানুষের প্রশ্ন। তা ছাড়া দূষিত রাজনীতির কারণে পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়েছে। শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও স্বদলপ্রীতি; পাণ্ডিত্য নয়, প্রধান যোগ্যতা দলীয় দাসত্ব, পদোন্নতিতে নির্লজ্জ স্বজনপ্রীতি, ছাত্র ভর্তিতে দুর্নীতি, পরীক্ষার মধ্যে অসাধুতা, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টেন্ডারে শিক্ষক-ছাত্রনেতাদের সমন্বিত অসাধু পন্থা অবলম্বন—এরপর গবেষণা, জ্ঞানচর্চা ও স্বাধীন চিন্তার অনুশীলন সম্ভব নয়। সমাজপতিরা জানেন না তাঁরা কী করছেন। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক